শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪

বেগম রোকেয়ার ধর্মচেতনা

আপডেটেড
৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ১০:৫৯
মোহাম্মদ হাননান
প্রকাশিত
মোহাম্মদ হাননান
প্রকাশিত : ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ১০:৩৮

রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামটি বেগম রোকেয়ার জন্য দেশে ও বিদেশে বিখ্যাত। রোকেয়া এ গ্রামে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম ছিল ‘রোকেয়া খাতুন’। বিয়ের পর তিনি নিজেই স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখেন ‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’। ‘মিসেস আর এস হোসেন’ নামেও তিনি লেখালেখির জগতে পরিচিত ছিলেন। তবে ‘বেগম রোকেয়া’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম নারীদের মধ্যে বেগম রোকেয়া ছিলেন তার সময়ের একজন সফল গদ্যকার। বাঙালি মুসলিম সমাজে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছিলেন তার সামাজিক আন্দোলনের প্রশ্নে। তার জীবন ইতিহাসকে মূল্যায়ন করে বলা হয়, তিনি বাঙালি মুসলিম আন্দোলনের অগ্রদূত। তার সমকালে তাকে পুরোপুরি না বুঝে, না জেনেই একদল তার সমালোচনা করেছেন। আরেক দল রোকেয়ার সামগ্রিক দর্শনকে আত্মস্থ না করেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। দুই দলের হাতেই ছিল খণ্ডিত রোকেয়া। তারা রোকেয়ার জীবন দর্শন, লেখালেখি ও সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে খুব কমই পর্যালোচনা করে দেখেছেন। সব মিলিয়ে দুই দলই এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে, যাতে মনে হয়, বেগম রোকেয়া ধর্মের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে সুবিদিত অভিযোগ, তিনি পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু আসল সত্য কী?

তার রচনাবলি পাঠ করলে এ সম্পর্কে প্রকৃত সত্য কী তা বেরিয়ে আসে। প্রথমত, ইসলাম সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গিটা আমরা পরখ করে দেখতে পারি। ‘ইসলাম’ নামে লেখা তার একটি প্রবন্ধও আছে। এতে ইসলামের ইতিহাস, আরবে নবী (সা).-এর সংগ্রাম, তার পাশে দাঁড়ানো স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর ভূমিকা তিনি বিশ্লেষণ করে ইসলাম সম্পর্কে তার ব্যুৎপত্তিকে জানান দিয়েছেন। মোহাম্মদ (সা.) প্রসঙ্গে লিখেছেন, “কেহ কখনও শুনে নাই, তিনি প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করিয়াছেন। তিনি সর্বদা বিপদগ্রস্তের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকিতেন, বিধবা ও পিতৃহীন শিশুদের সান্ত্বনা ও প্রবোধ দান তাহার নিত্যকর্ম ছিল। প্রতিবেশীবর্গ তাহাকে ‘আল আমীন’ বিশ্বস্ত বলিয়া ডাকিত। …তিনি যেভাবে আত্ম-বিস্মৃত হইয়া ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ঈশ্বর-অনুসন্ধান করিতেন, তাহা বর্ণনা করিবার উপযুক্ত ভাষা দুর্লভ; অথবা ইহার মর্ম কেবল তাহারাই বুঝিতে পারেন, যাহারা একাগ্রচিত্তে খোদার পথে আত্মসর্মপণ করিয়াছেন’। (বেগম রোকেয়া: ‘ইসলাম’, মূলগ্রন্থ: মতিচূর, দ্বিতীয় খণ্ড, বেগম রোকেয়া রচনাসমগ্র, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ঢাকা, ২০১৯ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৫৪)

বেগম রোকেয়া মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি কতটা ভক্তিপূর্ণ আর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তার আরেকটি নজির দেখানো যেতে পারে- ‘‘পয়গম্বর সাহেবের নিম্নোক্ত বচনসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমি ভক্তিপ্রেমে অভিভূত হইয়া পড়ি। তিনি বলিয়াছেন, ‘বিদ্বানের (লিখিবার) মসী শহীদ (ধর্মার্থ সমরশাহী)-দের রক্তপেক্ষাও অধিক মূল্যবান’। ভ্রাতৃগণ! বিদ্যার গৌরব বর্ণনা এতদপেক্ষা অধিক আর কি হইতে পারে”? (‘ইসলাম’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩)।

একই সঙ্গে ইসলামে বিদ্যা অর্জন, লেখাপড়া ও শিক্ষাকে কত গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে সে বিষয়টিও রোকেয়া মন্তব্যসহ উপস্থাপন করেছেন। রোকেয়ার সারা জীবনের আন্দোলন-সংগ্রাম এই লেখাপড়া নিয়েই। বোধকরি গত দু-তিন শতকে রোকেয়ার মতো এত শিক্ষা-সংগ্রামী সমগ্র দুনিয়ায় আর কেউ আসেননি। রোকেয়া লক্ষ করেছিলেন, একটি গোষ্ঠী ইসলামের নামে পর্দার কথা বলে মেয়েদের শিক্ষায় বাধা দিচ্ছে, ইসলামের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। রোকেয়া এর বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলেন।

রোকেয়ার রুখে দাঁড়ানোকেই অনেকে ব্যাখ্যা করেন যে, তিনি পর্দা, বোরকা এবং অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কস্মিনকালেও নয়, রোকেয়া কখনোই পর্দার বিরুদ্ধে কথা বলেননি। বরং আমরা দেখতে পাই, তিনি পর্দার পক্ষে ছিলেন। রোকেয়া মনে করতেন পর্দা না থাকলে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকে না।

বোরকা পরার জন্য অভ্যাসের প্রয়োজন আছে বলে তাগিদ দিয়েছেন রোকেয়া। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘বিনা অভ্যাসে কোন কাজটা হয়?’ তবে রোকেয়া বোরকার উন্নতি দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জুতা, কাপড়সহ প্রভৃতির ক্ষেত্রে যেমন ক্রমশ উন্নতিপ্রাপ্ত হইয়াছে, সেইরূপ বোরকারও উন্নতি প্রার্থনীয়’। (বোরকা, পৃষ্ঠা ৪০)।

সমকালে প্রচারণা চলত যে, মেয়েরা যে পিছিয়ে পড়ছে, সেটা পর্দা প্রথার কারণেই। কিন্তু রোকেয়া তা মনে করতেন না। তিনি সমস্যার মূল জায়াগাটিই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘সম্প্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ, সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই- শিক্ষার অভাবে হইয়াছে’। (‘বোরকা’, পৃষ্ঠা ৪১)। রোকেয়ার সংগ্রামটা ছিল এখানেই। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হলো শিক্ষায় পিছিয়া থাকা।

এ জন্য রোকেয়া পুরুষদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন, তারা যে ‘টাকার শ্রাদ্ধ’ করে মেয়েদের অলঙ্কারে শোভিত করে থাকেন, সেটা না করে তারা যেন মেয়েদের ‘জ্ঞান ভূষণে’ অলঙ্কৃত করে তোলেন। রোকেয়ার অমৃত বাক্য, ‘একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তক পাঠে যে অনির্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলঙ্কার পরিলে তাহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অলঙ্কারের টাকা দ্বারা জেনানা স্কুলের আয়োজন করা হউক’। তবে রোকেয়া সন্দেহ করেছেন, অলঙ্কারপ্রিয় মেয়েরা এটা মেনে নেবেন কি না। তাই তিনি বলেছেন, ‘ভগ্নীগণ যে স্কুল লাভের জন্য সহজে গহনা ত্যাগ করিবেন, এরূপ ভরসা হয় না’ (‘বোরকা’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪১)। রোকেয়ার সিদ্ধান্ত, ‘পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাঁটা হইয়া দাঁড়ায় নাই’ (‘বোরকা’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪২)।

আবার বেগম রোকেয়া মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘মসুলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষায় কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন’। কিন্তু আমরা সাধারণরা কোরআন শিক্ষাটা যেভাবে করি রোকেয়ার তাতে আপত্তি। তিনি বলেন, ‘কোরান শিক্ষা অর্থে শুধু টিয়া পাখির মত আরবি শব্দ আবৃত্তি করা আমার উদ্দেশ্য নহে’। তিনি পবিত্র কোরআন মাতৃভাষায় অনুবাদ করে অথবা বলা যেতে পারে, অর্থ বুঝে কোরআন পড়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। কোরআন শেখার এ অবস্থানের কারণে কেউ তাকে সমালোচনা করতে পারে, এটা ভেবে রোকেয়া বলেন, ‘আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরআন শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোঁড়ামির পরিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোঁড়ামি হইতে বহুদূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম ও সমাজ অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য কোরান শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন’। (সওগাত সাময়িকী, চৈত্র, ১৯৩৩)।

অন্যান্য আরও রচনায় ধর্ম এবং ইসলাম সম্পর্কে রোকেয়ার ভাষ্য এবং তুলনামূলক আলোচনা সবাইকে বিস্মিত করে। তিনি সংবাদ-সাময়িকীতে একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘এই বিশাল জগতে কোনো দেশ, কোনো জাতি, কোনো ধর্ম্ম নারীকে কিছুমাত্র অধিকার দান দূরে থাকুক, নারীর আত্মাকেও স্বীকার করে নাই। একমাত্র ইসলাম ধর্ম্মই নারীকে তাহার প্রাপ্য অধিকার দান করিয়াছে’। অন্যত্র বলেছেন, ‘কোনো জাতি কন্যাকেও সম্পত্তির ভাগ দেয় নাই, ইসলাম কন্যাকে পৈত্রিক সম্পত্তিতে ভ্রাতার অর্ধেক অংশ ভাগিনী করিয়াছে।…মুসলিম স্ত্রী নিজের সম্পত্তি স্বচ্ছন্দে ভোগ করিবার অধিকারিণী’ (বেগম রোকেয়া: ‘রানী ভিখারিনী’, মাসিক মোহাম্মদী, পৌষ ১৩৩৪)।

সমকালে ইসলাম সম্পর্কে অনেক ইসলাম বিশেষজ্ঞও রোকেয়ার মতো ইসলামকে এমন সুন্দর করে তুলে ধরতে পারেননি। রোকেয়া এটা কেন পেরেছিলেন, কারণ ইসলামি তত্ত্ব ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে তার ছিল অগাধ পড়াশোনা ও জ্ঞান। ফলে সমকালে যেসব মুসলমান সামাজিক নেতা ইসলামের নামে নানা রকম ভুল ব্যাখ্যা এবং নারীবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিল, বেগম রোকেয়া ইসলামি তত্ত্ব দিয়েই তাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, যেসব অপব্যাখ্যা করা হতো, রোকেয়া তারও সমুচিত জবাব দিতেন।

মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে গিয়ে রোকেয়া লেখেন, ‘হিন্দু স্ত্রীকে মৃত স্বামীর সহিত পোড়াইয়া মারিবার ব্যবস্থা আছে।…কিন্তু ইসলাম নারীকে পুনর্বিবাহের অনুমতি দিয়াছে।… হিন্দুগণ শাস্ত্রানুসারে স্ত্রীলোকের প্রতি গৃহপালিত পশু ‍কিংবা দাসীর ন্যায় ব্যবহার করিতে বাধ্য’। কিন্তু ইসলাম ধর্ম্মে স্ত্রীলোককে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দান করা গিয়াছে’ (‘রানী ভিখারিনী’, পূর্বোক্ত)।

খ্রিষ্টীয় সমাজ সম্পর্কেও রোকেয়ার মূল্যায়ন রয়েছে। তিনি লেখেন, ‘খ্রিস্টিয়ান সমাজে যদিও স্ত্রী শিক্ষার যথেষ্ট সুবিধা আছে, তবু রমণী আপন স্বত্ত্ব ষোল আনা ভোগ করিতে পায় না। তাহাদের মন দাসত্ব হইতে মুক্তি পায় না (রোকেয়া: অর্ধাঙ্গী, মূলগ্রন্থ: মতিচূর, প্রথম খণ্ড, পুর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯)। রোকেয়া মনে করতেন, ‘ইংল্যান্ডের লোকদিগকে মসুলমানরাই তাহাদের বিস্মৃত বিদ্যার বর্ণমালার পুস্তকবলী অধ্যয়ন করাইয়াছিলেন’। তিনি লিখেছেন, ‘একসময় ইউরোপের খ্রিষ্টীয় বিভাগ কেমন ঘোর মূর্খতায় তমসাচ্ছন্ন ছিল।’ (বেগম রোকেয়া: ইসলাম, মূল গ্রন্থ: মতিচূর দ্বিতীয় খণ্ড,পূর্বোক্ত,পৃষ্ঠা ৬৪)।

রোকেয়ার সুবিখ্যাত গ্রন্থ অবরোধ-বাসিনী। এখানে পর্দা, বোরকা এবং অবরোধ প্রথা বিষয়ে নানা রকম গল্প-কাহিনির একটি সংগ্রহ উপস্থাপিত হয়েছে। বিষয়গুলো নারীদের এবং নারীদের জন্য এবং নারীদের দ্বারা পর্দা নিয়ে যেসব কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি আছে- তার একটি সংগ্রহ। রোকেয়া এসব সংগ্রহের মাধ্যমে নারীদের এ বার্তাই দিতে চেয়েছেন, পর্দা সম্বন্ধে তাদের সংস্কারগুলো আসলে পর্দা না, এগুলো এক ধরনের অশিক্ষা। যেমন- ‘এক বাড়িতে আগুন লাগলো, গ্রামের মানুষ আগুন নিভাতে এসেছে, কিন্তু গৃহিণী ঘর থেকে বের হলেন না, কারণ এতে তার পর্দা ছুটে যাবে। ফলে তিনি পুড়েই মারা গেলেন’ (রোকেয়া, অবরোধ-বাসিনী, পূর্বোক্ত ২৩৪)।

রোকেয়া দেখেছিলেন, সমাজের একদল পুরুষ সামাজিক পর্দা বিষয়ে তাদের মনগড়া তত্ত্ব চালিয়ে সমাজে নারীদের অবনমিত রাখার চেষ্টা করছেন। আর মেয়েরাও পর্দা সম্বন্ধে মূল শিক্ষাটা পাননি। ফলে তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা করেছিলেন তা পর্দার মূল প্রণোদনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রোকেয়া সমসাময়িককালে ইসলামি পণ্ডিত ছিলেন, কোরআন-হাদিস তিনি আয়ত্ত করেছিলেন, ফলে শরিয়া বিধানকে সামনে নিয়ে এসেই বেশি সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি এভাবে ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধকেই জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন।

রোকেয়ার সংগ্রামের মূল ইস্যু ছিল মেয়েদের লেখাপড়া শিখতে দিতে হবে। কোরআন-হাদিসকে উদ্ধৃত করে তিনি এর স্বপক্ষে যুক্তিগুলো তুলে ধরেছিলেন। ইসলাম বিষয়ে তার ছিল প্রবল অনুরাগ, সে অনুরাগের প্রকাশ তার লেখালেখির সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তেমনি মেয়েদের শিক্ষার বিষয়টিও তিনি সমাজের অগ্রাধিকার ইস্যুতে পরিণত করেছিলেন। আজকের বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ভর্তির হার প্রায় শতভাগ, আর ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অগ্রগামিতার যে ফলাফল আসছে, তা বেগম রোকেয়ার সংগ্রামের সফলতারই অংশ।

লেখক: ইতিহাসবিদ ও গবেষক


বাংলাদেশ হাইকমিশন যুক্তরাজ্যের কাছে প্রত্যাশা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. আজিজুল আম্বিয়া

বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের প্রধান কূটনৈতিক মিশন। হাইকমিশন লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনের কুইন্স গেট রাস্তায় অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকার ম্যানচেস্টার এবং বারমিংহামে অবস্থিত দুটি সহকারী হাইকমিশন ও পরিচালনা করে। অধিকন্তু এটির আয়ারল্যান্ডের সমবর্তী স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে অনুমান করা হয় যে প্রায় ৫৫০০০০ বাংলাদেশি এখানে বসবাস করছেন। যাদের মধ্যে ৯৫% অভিবাসী সিলেটি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক বাস করছেন পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হেমলেটে যা ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৩৩ ভাগ। এ কারণে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনের চেষ্টা কওরা উচিত বলে গুণীজন মনে করেন। তাই হাইকমিশন ও এই এলাকায় বিশেষ তৎপরতা চালিয়ে যান। বাংলাদেশি সিলেটিরা এখানে সুপ্রতিষ্ঠ। বর্তমান হাইকমিশনার যিনি অনেকটা সফল হিসেবে অনেকে মনে করেন। তিনি হলেন সাইদা মুনা তাসনিম । তিনি অনেক ভালো কাজ করার চেষ্টা করছেন বলে এখানকার মানুষের ধারণা রয়েছে। তার অনেক সুনাম ও রয়েছে দেশে ও বিদেশে। এ কূটনীতিবিদরা বাংলাদেশের বৃহৎ দাবিগুলো নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাব আনেন এবং দাবি জানান। তারা দেশের জন্য কাজ করেন নিরলসভাবে। উনারা এখান থেকে দেশের জন্য কূটনৈতিক কাজ চালিয়ে যান ইউকেসহ সারাবিশ্বের সঙ্গে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বাজেটের টাকার সিংহভাগ গিয়েছিল এই দেশের ব্রিটিশ বাঙালিদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দেশের মানুষের বিরাট ভূমিকার কারণে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে জীবিত অবস্থায় পাকিস্তানিরা এই দেশে পাঠাতে বাধ্য হয়। আর এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের উদ্দেশ্যে ফিরে যান তার দেশে। তাই এই দেশ বাঙালির অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে । এ কারণে সব সময় বাংলাদেশের কাছ থেকে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে যুক্তরাজ্য কিন্তু অভিযোগ আছে এখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী মানুষ পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সার্ভিস। ২০১৮ নভেম্বর মাস থেকে এখন পর্যন্ত সাইদা মুনা তাসনিম এই দায়িত্বে আছেন। তিনি সম্প্রীতি তার কাজের জন্য ডিপ্লোম্যাট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। তিনি কাজ করে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনছেন অথচ এখানকার অনেক বাঙালি এই হাইকমিশন অফিসের কর্মচারীদের কাজে খুশি হতে পারছেন না এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। অবশ্য বর্তমান হাইকমিশনার আসার পর সেবার মান উন্নত করার চেষ্টা করছেন এবং করেও যাচ্ছেন কিন্তু এই অর্জন ম্লান করে দিচ্ছেন উনার অফিসের এই কিছু কুচক্রী লোক। মানুষকে সঠিক সেবা দেওয়ার স্বার্থে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার এখন সময় এসেছে বলে সুশীলরা মনে করছেন। এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করা হয় মর্যাদার সঙ্গে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করা হয় দিনরাত। বর্তমান হাইকমিশনার আসার পর সর্বপ্রথম বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ দেখা করলেন । বাংলাদেশের জাতীয় দিবসে এখন এই দেশের অনেক জায়গাতে বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়তে দেখা যায়। বাংলাদেশ হাইকমিশন বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য বিভিন্ন সভা ও সেমিনার এর আয়োজন করে থাকে যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ অবদান রাখছে । বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে যে যে কাজ করা হয় তা হলো- ই-পাসপোর্ট ও মেশিন রিডাবল পাসপোর্ট (এমআরপি), এনআইডি, ভিসা, প্রত্যয়ন দলিল, জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু নিবন্ধন, পাওয়ার অব এটর্নি, দ্বৈত নাগরিক সনদপত্র, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, পুলিশ কিলিয়ারেন্স ফর ফরেন ন্যাশনাল, ভ্রমণের অনুমতি, নো ভিসা রিকয়ারড (এনভিআর), বিভিন্ন অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব কাজ করতে আসা মানুষের নানা অভিযোগ রয়েছে। হাইকমিশনের ওয়েবসাইট এ যে হেল্প নাম্বার দেওয়া রয়েছে তাতে কল করলে সব সময় উত্তর আসেনা অন্যান্য হাইকমিশনের মতো। ওয়েবসাইট ও উন্নতমানের নয় এই অভিযোগ অনেকেই করেন । এখানে সহজে প্রবেশ করা যায়না সব সময়। এ ছাড়া এখানে কিছু বুঝতে অক্ষম হলে সাহায্য করার মতো কাউকে পাওয়া যায় না। অফিসে গেলে তারা বলেন, এটা করেন, ওটা করেন কিন্তু দেখানের কেউ নেই তাই মানুষ বাধ্য হয় দালালের কাছে যেতে। আর দালালরা প্রতিটি কাজে ৩০ পাউন্ড থেকে ৬০ পাউন্ড পর্যন্ত চার্য করে থাকেন । উপায় নেই তাই মানুষকে এই টাকা দিতে হয়। হেল্পলাইনে কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে তা অজানাই থেকে যায় অনেকের। তখন অসম্পূর্ণ কাজ নিয়ে অফিসে যেতে হয়। সেখানে গিয়েও অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয় এই সাধারণ মানুষের। অথচ এই দেশে অন্যান্য হাইকমিশনে কল করার সঙ্গে সঙ্গে অপশন আসে এখানে কোনো অপশন চান সেটি পছন্দ করার জন্য বলা হয় এবং যে বিষয়ে দরকার সেই বিষয়ে পরামর্শদাতা নিজে কথা বলেন ফোনে এবং যেকোনো সমস্যার ও সমাধান করে দেন নিজে । এখানে কিন্তু এটি স্বপ্ন। অথচ একই দেশে দুই সিস্টেম চালু রয়েছে। তাই দিন দিন মানুষ এই প্রতিষ্ঠানকে অথর্ব বলে ভাবতে শুরু করেছে। ইমেইল করলেও সঙ্গে সঙ্গে অনেকে রেস্পন্স পান না বলে অভিযোগ আছে। সিরিয়াল এ অনিয়ম নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেছে অনেকে মনে করেন বলে গুজব আছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সম্মানিত নাগরিকবৃন্দকে সিরিয়ালে নাম ডাকার সময় সম্মানের জায়গাতে অসম্মানিত করা হচ্ছে অবস্হা দৃস্টে অনেকে ভাবেন এই কথা। কেউ কেউ জানান মনে হয় পাকিস্তানের কোনো অফিসে বাঙালিকে কটাক্ষ করে কেউ নাম ডাকছেন, সিরিয়াল অনেক সময় বেশ দীর্ঘ হয় কিন্তু ট্র্যাভেল এজেন্সির লোক বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে দেখা যায় হরহামেশা। এই হলো সাধারণ মানুষের অভিযোগ। অফিসের ভিতরের লিফট নষ্ট কিন্তু এটি কেন ঠিক হচ্ছে না কেন তা জানা নেই মানুষের। তাই অক্ষম ব্যক্তিরা ই ভিসার আবেদন করলে সম্ভব হচ্ছেনা এই কাজ সম্পন্ন করা । কারণ মেশিন রাখা হয়েছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে তাই এ কাজ কি করে করা সম্ভব? সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় তাদের তখন দীর্ঘসময় বসে থাকতে হয় তা দুই তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ও ছাড়িয়ে যায় অনেক সময় এটি হলো ভুক্তভুগোদের কথা। এ ছাড়া শুনতে হয় অনেক তিরস্কার, অফিসাররা খুব ব্যস্ত থাকার বান করেন, যেখানে ইউকে সরকার সিলেটি ভাষাকে সম্মান করে বিভিন্ন জায়গাতে সিলেটি অনুবাদক রেখেছেন সেখানে অনেক স্টাফ আছেন এখানে তারা এই ভাষাভাষী মানুষদের অবজ্ঞা করছেন বলে শক্ত অভিযোগ আছে এই দেশের মানুষের কাছ থেকে। কেউ কেউ নীরবে হজম করছেন এই অবজ্ঞাকে। এরকম ও অভিজ্ঞতা আছে অনেকে বলেন , অনেক সময় লাইনে থেকে অনেককে বলতে শুনা যায় আমারা তাদের দেশের লোক না । মানে সিলেটি না হলে হয়তো ভালো ব্যবহার পাওয়া যেত। সিলেটিরা এই বিসয়ে খুব ক্ষুদ্ধ বলা যায়। সিলেট অঞ্চলের মানুষ বেশি এই দেশে তবুও কেন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হাইকমিশন অফিসে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ১ দুই জনের বেশি সিলেটি লোকজন কে চাকরি দিতে চায়না বাংলাদেশ সরকার এই প্রশ্ন এখন সব সিলেটি মানুষের মনে। তাই তারা এখন নারাজ বলা যায় সরকারের ওপর।

সেবা নিতে আসা অনেকে জানান, কর্মচারীদের কাউকে যদি বলা হয় আমাদের ট্যাক্সের টাকায় সরকার আপনাদের বেতন দেয় তবে কেন আপনারা এই কাজে আমাদের ঠিকমতো সহযোগিতা করেন না? তখন তিনি জানান, আপনাদের টাকায় আমাদের বেতন হয় না; কিন্তু প্রশ্ন হলো এ রকম উত্তর কি শুভা পায় একজন সরকারি কর্মচারীর মুখে। এ দেশে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অনেক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ লাভ করেন নিয়মিত কিছু মানুষ। এরা এই কমিশনের পছন্দের লোক বলা যায়। কিন্তু বিশাল এই দেশে যে অন্য গুণীজনরা রয়েছেন বা তৈরি হচ্ছেন সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মনে হয় এই কমিশনের । তাই এই তালিকার বাহিরের কিছু সুশীলরা দাওয়াতের বাহিরে থাকেন সব সময় । লন্ডনে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে হাই কমিশনের তেমন একটা তৎপরতা দেখা যায়না । এদেশে বছরে একবার বইমেলা হলেও হাইকমিশন অফিস থেকে কোনো অর্থনীতিক সহযোগিতা করতে পারছেন বলে কোনো খবর মিলছে না; কিন্তু এই দেশে যারা বসবাস করেও বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করছেন তারা খুব একটা সচ্ছল নয়, আমরা তা জানি। তাই এই বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত বলে সুশীলরা মনে করেন। এদিকে পাসপোর্ট করতে আসা অনেক ব্রিটিশ নাগরিকরা জানান, অফিসের অসহযোগিতা আর অনিয়মের কারণে মনে হয় বাংলাদেশি পাসপোর্ট না করলেই ভালো হতো। কেন এই বিতৃষ্ণা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এখানে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত তৈরি করা উচিত। যেখানে মানুষ রিপোর্ট করতে পারবে সহজে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার লাভ করতে পারবে। এখানে অনেক সময় বিচার দেওয়ার জন্য ও সঠিক জায়গা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বিচারপ্রার্থী হলে কর্মকর্তারা দায় এড়ানোর জন্য বলেন লিখিত অভিযোগ করেন। এই সময় এ দেশের মানুষের সবার নেই এটা তারা জেনেই এই সুবিধা নেন বলে অনেকে ধারণা করেন । যদি বাংলাদেশ সরকার ছদ্ম বেশে একদল তদন্তকারী সেখানে প্রেরণ করে, তবে এই অনিয়ম চোখে পড়বে বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন এবং সব অফিসে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে যদি আসা হয় আর তা যদি প্রতিনিয়ত চেক করা হয় তবেই এই অনিয়ম চোখের সামনে আসবে আর এই অসাধু লোকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক


নাম না জানা দেশই হোক তারুণ্যের কর্মসংস্থান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রফেসর ড. মো. নাছিম আখতার

শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ গড়তে চাই জনগণের কর্মসংস্থান। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের চাকরি। সৎ উপায়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাদের দেশ অত্যন্ত জনবহুল দেশ। এ দেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ স্বভাবতই দেশের জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। তাই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে রয়েছে হতাশা ও উৎকণ্ঠা। একটি জাতীয় পত্রিকার পরিসংখ্যানে দেখেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের প্রায়ই ৬৪ শতাংশ বেকার থাকছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও চাকরিবিহীন গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। শিক্ষিত হওয়ার ফলে তরুণ প্রজন্মের দ্বারা খেত-খামারে কাজ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে, আবার চাকরিও দুর্লভ। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পিয়ন পোস্টে ৪টি পোস্টের জন্য ১৬ শ আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে আবার অসংখ্য আবেদনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনার্স-মাস্টার্স। একটি সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে দেখেছিলাম ২১টি পৃথক পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ১ লাখ ২১ হাজার। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি সরকারি চাকরির জন্য মানুষ ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে তদবির করছে, যা দেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের শামিল। এমন কঠিন প্রতিযোগিতাময় পরিবেশে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে থাকছে চরম হতাশা। এখান থেকেই মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার মতো মানসিক সমস্যা বেড়েই চলেছে। আবার এসব তরুণকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজের স্বার্থান্বেষী ও দুর্জন ব্যক্তিরা অপকর্মে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি জাতীয় পত্রিকার একটি খবরে দেখলাম শিক্ষিত এক তরুণকে ব্যবহার করা হয়েছে একজন রাজনীতিবিদকে খুন করার জন্য। বিনিময়ে তার আগের সব মামলা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ যত বাড়ানো যাবে এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ততই কমবে। তরুণ প্রজন্মের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন নয়, দরকার কর্তৃপক্ষের প্রজ্ঞা ও শিক্ষিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষই দেশটির নাম জানেন। দেশটি ওসেনিয়ার অন্তর্গত একটি দেশ। নাম তার ‘পালাও’। ৪৬৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে ২২ হাজার লোকের বসবাস। যার মধ্যে ২ হাজার লোকই বাংলাদেশি। ২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সুপারি বাগানের সুপারি তোলা ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া বাঙালিরা সেখানে সমুদ্রে সার্ফিং এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশটির মাথাপিছু আয় ১৭ হাজার ৪৩৮ মার্কিন ডলার। এমন নাম না জানা দেশে মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগই বাঙালি। পৃথিবীতে এমন নাম না জানা বা কম পরিচিত অনেক দেশ আছে যেখানে আইন-শৃঙ্খলা, পরিস্থিতি, বসবাসের পরিবেশ আকর্ষণীয়। এসব দেশে বেঁচে থাকার মতো কর্মসংস্থান তৈরি করার উদ্যোগ, চেষ্টা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটানো যেতে পারে। তাহলেই দূর হবে বেকার সমস্যা।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সবাই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভিন দেশে নিজেদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তৈরি করেছিল। উপনিবেশগুলো থেকে আহোরিত অর্থ জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা ও শিল্পোৎপাদন ব্যবহার করে তারা উন্নত ও ধন সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমে এসে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো ইউরোপ এবং আমেরিকার উন্নত দেশগুলি প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠনে আফ্রিকার দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের চাহিদার বিরাট অংশ আসে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। আফ্রিকানদেরকে মদ ও মাদকে আসক্ত রেখে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ, বিগ্রহে ব্যস্ত রেখে ইউরোপিয়ানরা নির্বিঘ্নে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিচ্ছে।

করোনা মহামারি একটি বিষয় আমাদের শিখিয়েছে তা হলো শুধু টাকা থাকলেই চলবে না। জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের মৌলিক প্রাকৃতিক রসদ দেশের মধ্যেই থাকতে হবে। করোনার সময় সিঙ্গাপুরে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। কারণ শিল্প ও ব্যবসায় উন্নত হলেও সিঙ্গাপুর তার মোট চাহিদার ১০ ভাগ খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করে। বাকি অংশের জন্য তারা বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। করোনায় সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ায় সেখানে খাদ্যাভাব হয়েছিল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সারা পৃথিবীতে তেল, গ্যাস খাদ্য দ্রব্যের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই যুদ্ধে ইউরোপের প্রাকৃতিক সম্পদের দেউলিয়াত্ব বিশ্ববাসীর কাছে ফুটে উঠেছে। তাই ইউরোপকে শুধু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে ধরলে আমাদের জন্য বোকামি হবে।

আফ্রিকার মহাদেশের কথা শুনলেই অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি মহাদেশের কথা মনে পড়ে। আফ্রিাকার দেশগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখি তাহলে আমাদের আজন্মকাল লালিত ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটবে- আফ্রিকার শহরগুলোর অবকাঠামোগত সৌন্দর্য আমাদের আধুনিক ইউরোপের কথা মনে করিয়ে দেবে। ২০২১ সালের গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) সূচক অনুয়ায়ী আফ্রিকার ১০টি দেশ যথাক্রমে মরিশাস, বতসোয়ানা, ঘানা, জাম্বিয়া, সিয়েরা লিওন, সেনেগাল, তানজানিয়া, নামিবিয়া, লাইবেরিয়া ও মালাউই এর শান্তির সূচক যথাক্রমে ২৮,৪১,৩৮,৭১,৪৬,৫৪,৫৮,৬৫,৭৬ ও ৫৯। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে একই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম। আফ্রিকার ধনী দেশের মধ্যে রয়েছে সিশেলস, মরিশাস, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, গ্যাবন, বতসোয়ানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মিশর। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া অন্য নয়টি দেশেই জীবন ও জীবিকা অত্যন্ত নিরাপদ। গ্লোবাল ইকোনমি ফোরামের তথ্য মতে ২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার মোট জিডিপি হবে ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই।

২০২১ সালে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) র‌্যাংকিংয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে উরুগুয়ে, চিলি, আর্জেটিনা, প্যারাগুয়ে ও পেরু। এখানে উল্লেখ্য উরুগুয়ের জিপিআই সূচক যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে বড় দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ গায়ানা। যা বিট্রিশ কলোনি ছিল এবং এখানকার মাতৃভাষা ইংরেজি। এর জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ এবং সাম্প্রতিক কালে তেল উত্তোলিত হচ্ছে। তেলনির্ভর এই দেশটি বাংলাদেশিদের কর্মক্ষেত্র হতে পারে। এর পাশেই রয়েছে সুরিনাম নামে আরও একটি বাংলাদেশের সম আয়তনের দেশ যা হল্যান্ড শাসিত ছিল। লোকসংখ্যা ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার। এ দেশটিও শিক্ষিত বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের নতুন গন্তব্য হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘অর্থনৈতিক কূটনীতিতে গুরুত্ব দিতে হবে।’ তিনি বলেন ‘আজকের বিশ্বে কূটনৈতিক মিশনগুলোর দায়িত্ব পরিবতর্তিত হয়েছে। এখন রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি অবলম্বন করতে হবে, যাতে আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদার করতে পারি ও বিশ্বের সবার সঙ্গে একত্র হয়ে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারি।’ আমিও মনে করি, সচেতন মানুষ যাদের কর্মকাণ্ড দেশের সার্বিক পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারে তাদের স্লোগান হওয়া উচিত- ‘দূরদর্শী পরিকল্পনা করি, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ি।’

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আবুল কাসেম ভূঁইয়া

প্রকৃতি বাংলাদেশকে অপরূপ সৌন্দর্য দান করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক বেশি। তাই তো অতীতকাল থেকেই বিদেশি পর্যটকদের আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আকৃষ্ট করে আসছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। দেশের পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় এবং মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭৫ সালের দিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত পর্যটন করপোরেশন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে পর্যটন করপোরেশন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে অসংখ্য মোটেল, হোটেল, রেস্ট হাউস গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশে পর্যটন মৌসুম শুরু হয় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এ সময় দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। বাংলাদেশের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। এখানে সারা বছর ধরে পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। বিশেষ করে শীত মৌসুম পর্যটকদের ভিড় বেড়ে যায়। পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কক্সবাজারকে আকর্ষণীয় সাজে সজ্জিত করা হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে মানোন্নত রেল যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে মানোন্নত রেলযোগাযোগ চালু করা হচ্ছে। এই রেল যোগাযোগ চালু হলে পর্যটননগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ অনেকটা বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার রেল সার্ভিস চালু হলে পর্যটকরা সস্তিতে যাতায়াত করতে পারবে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে সরাসরি বিমান সার্ভিস চালু আছে। সড়ক পথে আন্তর্জাতিক মানসম্মত বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। পর্যটনশিল্পনির্ভর খাবার হোটেলসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখানে রয়েছে। কক্সবাজার পর্যটনশিল্পের সঙ্গে হাজার হাজার লোক সম্পৃক্ত রয়েছে। কক্সবাজার ছাড়া এখানে রয়েছে হিমছড়ি, ইনানী এবং টেকনাফ সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজারের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন স্পট। কাপ্তাই রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে রয়েছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। কাপ্তাইয়ে রয়েছে আকর্ষণীয় লেক, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র, রাঙামাটিতে রয়েছে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান, বান্দরবানে রয়েছে মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরি পর্যটন স্পট। বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ঘেরা মনোরম দৃশ্য পর্যটকদের সহজেই আকৃষ্ট করে থাকে। বান্দরবানে রয়েছে অসংখ্য উন্নতমানের হোটেল এবং রিসোর্ট। খাগড়াছড়িতে রয়েছে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাজেক। যাকে বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড বলা হয়। সাজেকে রয়েছে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা। তবে যাতায়াতব্যবস্থা এত উন্নত নয়। চট্টগ্রামেও রয়েছে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, ফয়েজলেক, বাটালী হিল, ওয়ার সেমিট্রি, চেরাগীর, পাহাড়, ভাটিয়ারী গলফ, কর্ণফুলী নদীর তীর পার্কি বিচ, সিআরবি, স্বাধীনতা পার্কসহ আরও অনেক দর্শনীয় স্থান। এসব স্থানে সবসময় পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। মিরসরাইয়ে রয়েছে মহামায়া লেক, সীতাকুণ্ডে রয়েছে সীতাপাহাড়। কুমিল্লায় রয়েছে ময়নামতি বৌদ্ধবিহার, বার্ড, লালমাই পাহাড়, ময়নামতি ওয়ার সেমিট্রি, ধর্মসাগর, রানীদীঘি, নানুয়াদীঘিসহ আরও নতুন নতুন পর্যটন স্পট। প্রাকৃতিকভাবে অপরূপ সাজে সজ্জিত সিলেটে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাফলং, রাতারকুল, বিছানাকান্দি, লালাখাল, চাবাগানসহ আরও অনেক পর্যটন স্পট। এসব পর্যটন স্পটে সবসময় পর্যটকরা আসেন। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। এ ছাড়া পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, মহাস্থানগড়, কুয়াকাটাসহ আরও অনেক পর্যটন স্পট বাংলাদেশে রয়েছে। দেশের এসব পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করলেও এসব স্থানে বিরাজ করছে বিভিন্ন সমস্যা। যা নাকি পর্যটকদের দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দেয়। বিশেষ করে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে পর্যটকরা চরম দুর্ভোগ পোহান। প্রায়ই পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের জন্য টয়েলেটে, রেস্ট হাউস, উন্নতমানের খাবার হোটেল, নামাজের স্থান নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ আরও অনেক সমস্যা। দেশের পর্যটনশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এই শিল্পকে যদি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে এই শিল্প থেকে সরকার প্রচুর রাজস্ব আয় করতে পারবে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের বিভিন্নস্থানে অবস্থিত পর্যটন স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় এবং উন্নতমানের করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোতে বিরাজমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে ডকুমেন্টারি ফ্লিম বা অ্যাড নির্মাণ করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, টিভি ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার এবং পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রিন্টিং মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোর প্রচারের জন্য তরুণদের নিয়োগ দিতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে তুলে ধরার লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচারণা চালাতে হবে। পর্যটকদের এদেশে আসার জন্য ভিসার সহজ ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি পর্যটকরা যাতে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন সে জন্য তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য ট্রেন, বাস, বিমানে বিশেষ সুযোগ রাখতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোতে বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্নত খাবার এবং বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে অর্থ আয়ের ব্যবস্থা করছে। আমাদের পার্শবর্তী রাষ্ট্র ভারতের পর্যটনশিল্প অনেক সমৃদ্ধশালী। প্রতি বছর ভারতে লাখ লাখ বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। এই বিদেশি পর্যটকদের দ্বারা ভারত সরকারের বিশাল আয়ের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। ভারত সরকার তাদের পর্যটনশিল্পকে দিন দিন আকর্ষণীয় করে তুলছে। ভারত ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নেপাল, দুবাই এখন পর্যটনশিল্পনির্ভর হয়ে পড়েছে। এসব দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা আসেন। আমাদের দেশের পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দেশের পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্ততাদের এগিয়ে আসতে হবে। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকলে দেশের পর্যটনশিল্প অনেক এগিয়ে যাবে। পর্যটনশিল্পের প্রকৃত উন্নয়ন আশা করছি।

লেখক: অর্থনীতিবিষয়ক প্রাবন্ধিক


কেন দেশের আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছে?

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মিজানুর রহমান 

এপ্রিল/২৪ থেকে সব অঞ্চলের মানুষ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পড়েছে। ঈদ ছুটি শেষ হতে না হতেই সপ্তাহব্যাপী মানুষের মুখে তীব্র গরমের কথা শোনা যাচ্ছে। দিন শুরু না হতেই ঝাঁজাল রোদ্দুর। মানুষ বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। বৈদ্যুতিক পাখা এ গরম সামাল দিতে পারছে না। এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকার বন্ধ ঘোষণা করেছে। হিট অ্যালার্ট জারি হয়েছে। বেশি কষ্ট হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের। ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে হিট স্ট্রোকে ২০ এপ্রিল/২৪ পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। ফোরকাস্টিং তথ্য মোতাবেক গত ৭৬ বছরে অমন গরম হাওয়া বইতে দেখা যায়নি। ২১ এপ্রিল/২৪ তারিখে আবহাওয়ার ফোরকাস্টিং থেকে আরও জানা যায় দেশের কয়েকটি এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির খবরে দেশবাসী শঙ্কিত যেমন- ষশোর ৪২.৬০ চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৪০ রাজশাহী ৪১.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস একই দিনে সৌদি আরবে ৩৮ বাহরাইনে ৩২ কাতারে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে দেশের তাপমাত্রা সৌদি আরবের চেয়েও বেশি। দেশের তাপমাত্রা এভাবে বেড়ে যাওয়াটা আমরাও কম দায়ী নই। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যেকোনো দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার; কিন্তু পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এ বছরের তথ্য মোতাবেক দেশে বনভূমির পরিমাণ ১৫ দশমিক ৫৮ ভাগ। কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে উজাড় হচ্ছে সেভাবে বৃক্ষরোপণ হচ্ছে কি? নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, এক সময় এ দেশে ১৩০০ নদী ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মোতাবেক এখন আছে ৪০৫টি, সেগুলোও হজম করার পাঁয়তারা চলছে। খাল-বিল-জলাশয় ভরাট করে ফসলি জমি ঘরবাড়ি করা হচ্ছে। বাধা দেওয়ার যেন কেউ নেই।

রাজধানী ঢাকায় অসহনীয় গরম পড়ছে। ঢাকায় নিজেদের ভোগ-বিলাসের জন্য পরিবেশের ওপর আমরাও অনেক আঘাত হেনেছি। তথ্যানুযায়ী গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের করা এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ কমে মাত্র ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে জলাভূমি নেমে এসেছে ২ দশমিক ৯ শতাংশে। ঢাকায় মাত্র ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় গাছপালা ও খালি জায়গা রয়েছে যা ১৯৯৫ সালে ছিল ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে জলাভূমি এলাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার। যা ১৯৯৫ সালে ছিল ৩০ দশমিক ২৪ বর্গকিলোমিটার। একটি আদর্শ শহরে ১৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ শতাংশ জলাভূমি থাকার নিয়ম রয়েছে। অন্যদিকে বারবার চুয়াডাঙ্গায় কেন তাপমাত্রা বেশি হচ্ছে সেটাও সবাই অবগত হলে বুঝতে বাকি থাকবে না নদী ও বনভূমির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। এ মাসে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। কেন সে জেলায় এত দাবদাহ? ভৌগোলিক দিক বিশ্লেষণে জানা যাবে এর কারণ কি? ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের যে অবস্থান সেই একই অবস্থানে আছে ভারতের রাজস্থান, সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের মরুভূমিগুলো অর্থাৎ এদেশগুলো একই অক্ষাংশে। প্রশ্ন জাগে উল্লিখিত অঞ্চলগুলো মরুভূমি হলে বাংলাদেশে কেন অমনটি নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ম্যাপে দৃষ্টিপাতে দেখা যাবে যে ম্যাপের মাঝামাঝি একটি রেখা অতিক্রম করেছে যার নাম হচ্ছে কর্কটক্রান্তি রেখা যা ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে। এই কর্কটক্রান্তি রেখাটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে প্রভাবিত করছে। আমরা জানি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এক সময় ঘুরতে ঘুরতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সরে যায়। এ সরে যাওয়ার কারণেই পৃথিবীর নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চল সরাসরি সূর্যের নিচে চলে আসে। যার কারণে উত্তর দিকের ২৩.৫ ডিগ্রি ও দক্ষিণ দিকে ২৩.৫ ডিগ্রির জায়গাটুকু সূর্যের সরাসরি নিচে অবস্থান করে। এ ২৩.৫ ডিগ্রি অক্ষাংশের রেখাটি বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে অতিক্রম করছে। পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে ২১ মার্চের পর ধীরে ধীরে উত্তর অংশ সূর্যের নিচে অবস্থান করে। আর যেহেতু চুয়াডাঙ্গার ওপর দিকে কর্কটক্রান্তি রেখাটি, স্বাভাবিকভাবে এ জেলার তাপমাত্রা অনুভূত হবেই। এ কর্কটক্রান্তি রেখা কিন্তু কুমিল্লা ও ফরিদপুরের দিক দিয়েও বিদ্যমান তাহলে সেখানে তাপমাত্রা তেমনটি নেই কেন? আমরা জানি জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে সমুদ্রের অবস্থান, প্রবাহিত নদী ধারার অবস্থান এবং ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর। তিনটি বিষয় চুয়াডাঙ্গার অনুকূলে নেই। সমুদ্র থেকে আসা বায়ুপ্রবাহের কারণে বায়ুমণ্ডলে নিয়ন্ত্রণ করে যেমন অধিক শীতল আবার অধিক গরম হতেও দিচ্ছে না। যার কারণে সমুদ্র তীরবর্তী জেলাগুলো যেমন পটুয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট এবং কক্সবাজারের আবহাওয়া খুবই সহনীয় পর্যায়ে থাকে। ফরিদপুরের পাশে আছে বিশাল নদী কুমিল্লার পাশে আছে ত্রিপুরার বিশাল বনভূমি যা আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। চুয়াডাঙ্গায় নেই সমুদ্র, নেই নদী পথ, নেই বনাঞ্চল। সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া চুয়াডাঙ্গা জেলা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১১.৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। যার ফলে পানির লেয়ারও অনেক নিচে অবস্থান করে। পানির লেয়ার নিচে থাকলে দ্রুত মাটি উত্তপ্ত হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে একই অক্ষরেখায় অবস্থিত ভারতের রাজস্থান সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের মরুভূমি এলাকা। ওই এলাকাগুলো মরুভূমি হওয়া সত্ত্বে ও বাংলাদেশের বেলায় তেমনটি না হওয়ার কারণ হলো, আমরা জানি বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বাড়লে সমুদ্র থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প উপকূলের দিকে ধাবিত হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এর জলীয়বাষ্প বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ধাবিত হলেই উত্তর অঞ্চলের হিমালয়ের পর্বতে ধাক্কা খেয়ে মেঘমালা তৈরি হয় এবং ধরণিতে বৃষ্টি নেমে আসে। এ সুবিধাটুকু তো ভারতের রাজস্থান সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের বেলায় নেই। বলাবাহুল্য বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে চমৎকার একটি দেশ। এ কারণে বাংলাদেশে মরুভূমি হয়নি। এ উত্তপ্ত পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতে চুয়াডাঙ্গাবাসীকে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে সবুজ-শ্যামল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে তখনই দেখা যাবে চুয়াডাঙ্গায় প্রচুর বৃষ্টি হবে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে। সামগ্রিকভাবে তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচতে হলে বনভূমি ধ্বংস আমরা না করি, ব্যক্তি স্বার্থে নদী ভরাট করা যাবে না নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে হবে। এ ছাড়া কলকারখানার নির্গত ধোঁয়া, যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস আমাদের বাতাসকে কলুষিত করছে। বাতাসের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃতি যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরে না আসে কি হতে পারে তা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান দাবদাহ থেকে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সরকার ও কঠোর অবস্থানে যেতে হবে, তাহলে পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষা পাবে এবং বর্তমান অবস্থান থেকে আমরাও পরিত্রাণ পাব।

লেখক: সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট


কর আহরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমরা কোথায় পিছিয়ে কেন?

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ

ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম, বিশেষ করে কর আহরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে সেসব দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়নের কারণে। যেমন- ভারত ১৯৬১ সালে, মালয়েশিয়া ১৯৬৭ সালে ঔপনিবেশিক আমলের আয়কর আইনকে যুগোপযোগী করে নেয়। ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া কয়েক বছর পরপর তাদের আয়কর আইনকে রীতিমতো ঢেলে সাজায়। একই সমতলে অবস্থানরত কমনওয়েলথ সদস্য দেশ বাংলাদেশে আয়কর আইনের আধুনিকতম সংস্করণ ১৯৮৪ সালে, তাও অর্ডিন্যান্স আকারে। তা যুগোপযোগী করতে, আইন আকারে পাস ও প্রবর্তনের কসরত চলছে গত দেড়যুগ ধরে। বাংলাদেশ ও ভারতের করব্যবস্থা, সুবিধা, ফরম্যাট মূলত একই। তবে একটা বড় প্রশাসনিক পার্থক্য হলো, বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর, এক মন্ত্রণালয় এবং একজন প্রশাসনিক চেয়ারম্যানের অধীনে। ভারতে তা নয়, সেখানে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ করের প্রশাসন আলাদা। ভারতে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের এবং পরোক্ষ কর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেও ভারতের কর বিভাগ বাস্তবায়নকারী হিসেবে স্বশাসিত। কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পলিসি প্রেসক্রিপশন ও থ্রেসহোল্ড দেওয়ার ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও একটা শক্তিশালী অবস্থান যেমন আছে তেমনি রাজ্যপর্যায়ে আছে স্থানীয় কর আইন ও ব্যবস্থাপনার সমান্তরাল প্রণয়ন ও প্রয়োগের সুযোগ।

আরেকটি হলো হিসাব সংরক্ষণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। বাংলাদেশেরও আছে; কিন্তু হিসাব পদ্ধতি, কোম্পানির আইন সবমিলিয়ে দেশগুলোতে একটা টেকসই সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও সে সড়কে বাংলাদেশের ওঠার প্রয়াস প্রলম্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এক হাতে হয়। তাই এখানে ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতিগত বিষয়গুলো অনেক জটিল, স্বেচ্ছা ব্যাখ্যা আচারি ও নিবর্তনমূলক হয়ে ওঠে। অনেকক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যা ধোঁয়াশে হয়ে যায়। ভারতে ভিয়েতনামে মালয়েশিয়ায় ওই সমস্যা তেমন একটা নেই। তারা অনেকটা স্বচ্ছ সংহত একটা আধুনিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে।

ভারতে পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কারণ দেশটির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আমদানি-রপ্তানির নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে যেহেতু শুল্কের ও মূল্য সংযোজন করের বিষয় জড়িত, সেহেতু সে মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হয়েছে শুল্ক ও ভ্যাট দপ্তরকে। ভ্যাট আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তনে বাংলাদেশ যথেষ্ট ধীর এবং এখনো দোটানায়। ভ্যাট মধ্যস্বত্বভোগকারীদের দখল থেকে সরকারি তহবিলে আনার আইন-কানুন কলাকৌশল যেন সহজেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বাংলাদেশে আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো যে মূল্য নির্ধারণ কিংবা ট্যারিফ ঠিক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিশন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এনবিআর শুল্ক কর হার নির্ধারণ ও আরোপের সময় সেটিকে তেমন একটা আমলে নেয় না। একইভাবে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক পরিশোধসংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপন জারি করতে গেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি আনতে হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের মধ্যে মতামতের রশি টানাটানিতে শুল্ক আহরণ মাঠে মারা যায়। এই ঝামেলা ভারতে নেই, নেই মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে, ভিয়েতনামের পরিস্থিতি আরও স্বচ্ছ ও সাবলীল। ভারতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই আমদানি-রপ্তানি বিধির আলোকে শুল্ক করাদি আরোপ করে। ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় শুল্কায়ন সিদ্ধান্তদানকারী টায়ার বা লেয়ার অনেক কম। অধিকাংশ দেশে ট্যারিফ কমিশন শুল্ক আরোপ থেকে শুরু করে সবকিছু দেখে। বাংলাদেশের ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে এনবিআরের সুযোগাযোগ নেই। গণশুনানি করে ট্যারিফ কমিশন; কিন্তু শুল্ক আরোপ করে এনবিআর। এই জটিলতা নিরসনে সংস্কারের কথা বলা হলেও তাতে খুব একটা অগ্রগতি নেই।

কর ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে আছে ভিয়েতনাম। দেশটির করব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মৌল পার্থক্য হলো ব্যক্তি এবং করপোরেট কর সম্পূর্ণ ব্যক্তি বা কোম্পানির ওপরই অর্পিত। কর পরিশোধ তাদের দায়-দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি যা ঘোষণা দেবে, তার ভিত্তিতেই করারোপ হবে। কালেভদ্রে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা দ্রুত নিরীক্ষা ও নিরসন করা হয়। নিরসনের স্বাধীনতা সেখানে দেওয়া আছে। ব্যক্তিকরের ক্ষেত্রে ইউনিভার্সাল সেলফ অ্যাসেসমেন্ট বাংলাাদেশে প্রবর্তনের সময় মনে করা হয়েছিল, ব্যক্তি করদাতাদের যদি কর অফিসে এসে রিটার্ন পূরণ করতে হয় তাতে অনেক সময় লাগে এবং জনে জনে এভাবে পরীক্ষা করে নেওয়াও সম্ভব নয়; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ইউনিভার্সল সেলফ ডিক্লারেশন সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না এই অনুযোগ অভিযোগ সন্দেহে অডিটের নামে করদাতাদের বারবার ডাকা হচ্ছে। এতেই কর প্রদানে আগ্রহ ও দায়িত্বশীলতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। ব্যক্তিকে যে ঘোষণা করার অধিকার দেওয়া হলো, শেষপর্যন্ত পারস্পরিক সংশয় সন্দেহ হয়রানির অভিযোগের ভাগাড়ে পড়ে অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। নোটিশ পেয়ে অফিসে গিয়ে ধন-সম্পদেও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে করদাতারা অনেকক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে প্রায়ই অভিযোগ উঠছে। আবার করদাতারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন না বলে রাষ্ট্র ও রেভিনিউয়ের স্বার্থে তাদের ডাকতে হচ্ছে। সীমিত লোকবল সম্পন্ন কর বিভাগের মনোযোগ ও সময় বিদ্যমান কর দাতাদের পিছনে ব্যয়িত হচ্ছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য এখানে। সেখানে আয়করের ক্ষেত্রে বলে দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব ব্যক্তির, কোম্পানির। কর যা দেওয়া হবে, কর অফিস তাই নেবে। এভাবেই চলছে। কোনো কোনো সময় অভিযোগ পেলে সেটি খতিয়ে দেখা হয়। বাংলাদেশের মতো গয়রহভাবে অডিট করা হয় না সেখানে। সেখানে কর আইন বেশ সুসংজ্ঞায়িত এবং বিস্তৃত। সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে সব কিছু। ফলে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগগুলো তেমন নেই। প্রতি বছর সংস্কার ও সহজীকরণের দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি।

বাংলাদেশে সহজীকরণের প্রয়াস চলছে তো চলছেই, পদ্ধতি সাপোর্ট করছে না। ঘুরে-ফিরে দেখা যায় একটা আন্তঅবিশ্বাস বিরাজ করছে। পরস্পরকে এড়িয়ে যাওয়ার এবং ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টাও চলছে। এ ধরনের ঘটনা ভিয়েতনামে খুব কম। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও সহজ ও পদ্ধতিমাফিক করায়ন ও আহরণের এবং বিভিন্ন কর রেয়াতের ব্যবস্থাও আছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য হলো এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক কর সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা থাকলেও রাজস্ব বিভাগের কাছে গিয়ে বাস্তবে তা আরেক রকম মনে হয়। একটার সঙ্গে আরেকটার সঙ্গতি নেই। ভিয়েতনামে এ ধরনের জটিলতা ও অসঙ্গতি খুব একটা নেই। রাজস্ব বিভাগ যা বলছে, সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানও তাই বলছে। বাংলাদেশে এরকম সমরূপতা নেই। ভিয়েতনামে বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আসার পেছনে এই নীতিগত সংহতি একটা বড় ভূমিকা রাখছে।

মালয়েশিয়ায় যেমন মাইডা (মালয়েশিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) সার্বিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমন্বয় করে। সেখানে কর, কাস্টম পলিসি সব এক জায়গাতে করা হয়েছে। অর্থাৎ মাইডা যা বলবে ওটাই শেষ কথা। ভিয়েতনামের সঙ্গে মালয়েশিয়ার পার্থক্য হচ্ছে তারা সব বিষয়গুলো সমন্বয় করে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের কাছে সব ধরনের ক্ষমতা দিয়েছে।

১৮৬০ সালে জেমস উইলসন ( ১৮০৫-১৮৬০) ব্রিটিশ ভারতে প্রথম আয়কর আইন প্রবর্তন করেন। ব্রিটিশরা ভারতের শাসনভার নেওয়ার পর প্রথম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিল তাকে। ১৮৫৯ সালে তিনি ভারতে আসেন, ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল তিনি প্রথম বাজেট বক্তৃতায় ‘জনসেবার’ জন্য রাজস্ব আহরণের যে ফর্মাট -ফর্মুলা দিয়েছিলেন, এখনো বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কমনওয়েলথ দেশগুলোতে তা অনুসরণ করা হচ্ছে। শুধু সংস্কার হয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি কর সংস্কৃতিতে ও অবকাঠামোয় ততটা উন্নত নয়, সেহেতু উন্নত বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি, রীতিপদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন সরাসরি কাট পেস্ট করে অনুসরণে সাফল্য আসতে ও টেকসই হতে বিলম্ব হচ্ছে। যে স্টেজে যে অ্যাটিচুড বা মনোভঙ্গি (মাইন্ডসেট) বা উপলব্ধি থাকার কথা সেটায় না থেকে যদি এটা ভাবা হয়, উন্নত অর্থনীতির মতো আমাদের- সব করদাতারা শিক্ষিত, করদানে দায়িত্বসচেতন এবং তারা আইনকানুন সব বোঝেন জানেন, তাহলে কর-দৃষ্টিভঙ্গি (মাইন্ডসেট) ভিন্ন আঙ্গিকে চলে যাবে। এমনতরো অবস্থায় রাজস্ব আহরণ পরিবেশ পরিস্থিতি প্রোগ্রেসিভ না হয়ে রিগ্রেসিভ হতে পারে। নতুন করদাতা আসতে যেহেতু চাচ্ছে না, বা তাদের আনা যাচ্ছে না, সেহেতু তাদের স্থলে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপ বেড়ে গেলে তারাও পথ খুঁজতে পারেন কীভাবে কর দেওয়া থেকে ফাঁকি দিয়ে পরিত্রাণ মিলতে পারে।

বাংলাদেশ রাজস্ব আহরণের অবস্থান ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় পিছিয়ে থাকার আর যেসব কারণ তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য অবারিত কর অব্যাহতি আর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি। বাংলাদেশে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের জন্য দেয় কর ও জরিমানা আরোপের সঙ্গে অনৈতিক পন্থায় অর্জিত আয়ের ওপর কর হার হ্রাস বা জরিমানা ছাড় দেওয়ার কিংবা ‘উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না করার সুযোগ দেওয়াকে এক করে দেখা হয়। দেখা যায়, একজন লোকের অপ্রদর্শিত অর্থ ঘোষণার সুযোগে দুর্নীতিজাত কালো টাকার মালিককে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ কর ছাড়। এটি একটি বড় ধরনের কর প্রণোদনা। আবার বলা হচ্ছে, কালো টাকার উৎস নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না অর্থাৎ দুর্নীতিবাজকে রাষ্ট্র সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বরং ইমিউনিটি দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতে ১৯৯৭ ও ২০১৫ সালে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সেখানে করের ও জরিমানার হার হ্রাস, জিজ্ঞাসাবাদেও অব্যাহতি ছিল না আর এ সুযোগ ছিল নির্দিষ্ট সীমিত সময়ের জন্য। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায়ও তাই। বাংলাদেশেই এসবের ব্যতিক্রম একমাত্র বাংলাদেশেই।

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই  

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদনব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি- সব মিলিয়ে আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের চমকপ্রদ উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে দেশের সামগ্রিক আর্থিক লেনদেন কার্যক্রমে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনে নতুন এক বিপ্লব ঘটেছে। প্রান্তিক মানুষও এখন ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য ও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এটা আজ সবাই উপলব্ধি করেছেন, আর্থিক খাতে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব। আগে দূরবর্তী উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে ব্যাংক থেকে সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভাতা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বয়স্ক, বিধবা, অসচ্ছল, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের অনেক দুর্ভোগ কষ্ট পোহাতে হতো। সাধারণ দুস্থ, দরিদ্র অসহায় মানুষের সেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দিনের অবসান ঘটেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের জাদু সব কষ্ট, দুর্ভোগ এক নিমিষেই দূর করে দিয়েছে তাদের। এখন ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা তাদের ভাতার টাকা পেয়ে যাচ্ছেন দ্রুত এবং ঝামেলাবিহীনভাবে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস মানে এমএফএস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুণ এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ এখন হাতে হাতে নগদ লেনদেনের বদলে নগদবিহীন আর্থিক লেনদেনের অর্থাৎ ক্যাশলেস সোসাইটির কথা ভাবছে। নগদ লেনদেনের ঝুঁকি ঝামেলা ও বিড়ম্বনা এড়াতে ডিজিটাল মানি ট্রান্সফারে ঝুঁকে পড়ছেন দেশের মানুষ। এটা ডিজিটাল বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক প্রকাশ।

ডিজিটাল বাংলাদেশ যুগে প্রবেশের কারণে আমাদের জীবনযাপন অনেকটা পাল্টে গেছে। আজকাল ব্যাংকের শাখায় না গিয়েও চেক উপস্থাপন না করে টাকা তোলা যাচ্ছে এটিএম বুথ থেকে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দ্রুত এবং খুব কম সময়ে বিভিন্নজনের কাছে টাকা পাঠানোর অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আগে ব্যাংকে গিয়ে টিটি কিংবা ডিডি অথবা পে অর্ডার ইস্যুর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হতো। তাতে অনেক সময় লেগে যেত প্রাপকের কাছে টাকা পৌঁছাতে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী স্বপ্ন হচ্ছে দেশের সব ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন ক্যাশলেস হয়ে যাবে। নগদ অর্থে আর লেনদেন হবে না, উন্নতির ধারাবাহিকতায় এমন পরিবেশের দিকে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। ক্যাশলেস সোসাইটি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মাত্র ৫ সেকেন্ডে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গ্রহীতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা এই সেবা পাওয়া যাবে। এতে সাধারণ মানুষ তাদের মোবাইল ফোনে টাকা পাবে। যে টাকাটা তারা একটা দোকানে গিয়ে খরচ করবে, সেটাও তারা মোবাইলে পেমেন্ট করে দেবে। তাদের হাতে আর ক্যাশ রাখার প্রয়োজন হবে না। তাদের কষ্ট করে আয় করা টাকাটা তাদের থেকে কেউ চুরি করে নিতে পারবে না। ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ হলে দুর্নীতি নির্মূলেও তা ভূমিকা রাখবে। আজ বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। তারা এখনো সম্পূর্ণ নগদ অর্থে লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল। তবে এই নগদ টাকা তো চুরি হতে পারে। তাদের টাকা লুট হতে পারে; এখানে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। আমরা যখন ক্যাশলেস সোসাইটিতে চলে যাব, তখন দুর্নীতির সুযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। আজ যত সরকারি ভাতা দেওয়া হয়, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেওয়া হয়। আগে টাকা চুরি হওয়ার, দুর্নীতি করার সুযোগ থাকত। সে সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ডিজিটাল আর্থিক সেবা অর্থাৎ ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবার বিকাশ এখন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করেছে। মোবাইল ফোন এবং ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার ধরনও পাল্টে গেছে এখন। ডিজিটাল ফাইন্যান্স অনুন্নত গ্রামীণজীবনে অত্যাধুনিক আর্থিক লেনদেন সেবাকে সহজলভ্য করেছে। যা আগের গতানুগতিক, প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না। কয়েক বছর আগেও যা কল্পনা করা যায়নি তা এখন সম্ভব হয়েছে। এখন ডিজিটাল রেমিটারের মাধ্যমে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ খুব কম সময়ের মধ্যে সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। গ্রামীণ দারিদ্র্যের মোকাবিলায় সরকারি নানা উদ্যোগ, প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী এবং গতিশীল করেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ফাইন্যান্স। আমাদের দারিদ্র্য দূরীকরণে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের বিভিন্ন বিষয় ইতোমধ্যে উজ্জ্বল সাফল্য দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়েছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের কোনো বিকল্প নেই, এটা সবাই উপলব্ধি করেছেন এর মধ্যেই। উদ্ভাবনী ক্ষমতার চর্চা এবং ডিজিটালাইটেজেশন বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করবে আশা করা যায়। উচ্চাভিলাসী হলেও সরকারি এবং বেসরকারি নানা উদ্যোগ এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন আর্থিক অনুদান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিভিন্ন ধরনের ভাতা খুব সহজে সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল ফাইন্যান্স বা আর্থিক ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশের সর্বস্তরের জনগণকে আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আনাটা মস্তবড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সে চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকায় তাদের পক্ষে আর্থিক লেনদেন বেশ কঠিন ছিল; কিন্তু ডিজিটাল ফাইন্যান্স তাদের জন্যও আর্থিক লেনদেনের চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে। এর সুবাধে শুধু টাকা জমা দেওয়া কিংবা উত্তোলন অথবা অর্থ স্থানান্তর নয়, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ, ভর্তি ফি প্রদান, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি জমাকরণ প্রভৃতি কাজ ব্যাংকে না গিয়ে ঘরে বসেই সম্পন্ন করতে পারছেন সবাই। এতে ব্যাংকে যাওয়া-আসার সময় বেঁচে যাচ্ছে, ব্যাংকে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের চাপ কমছে। তা ছাড়া নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি দূর করেছে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ভিসা কার্ড ইত্যাদির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের ব্যাপক জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বিশ্ব। সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয়। শুধু পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বের করলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে কী ঘটছে, দেখা যায়। এ ধারা থেকে ব্যাংকিং সেক্টর পিছিয়ে থাকবে কেন? এক সময় যে ব্যাংক আমানত গ্রহণ, হিসাবরক্ষণ আর ঋণ প্রদানে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ সে ব্যাংকে কী নেই! শুধু একটি অ্যাকাউন্ট থাকলে বেতন গ্রহণ, ইউটিলিটিসহ প্রায় সব ধরনের বিল প্রদান সম্ভব। আগে যে ব্যাংকে সামান্য একটি হিসাব বের করতে লেজার বুক নামে বড় বড় হিসাব খাতা কখনো কখনো ঘণ্টাব্যাপী খুঁজতে হতো, আজ মাত্র একটি ক্লিকে সব হিসাব বের করা সম্ভব। প্রযুক্তির ছোঁয়া মানুষকে গড়ে তুলেছে স্মার্ট হিসেবে। তারা এখন ঝামেলা পছন্দ করে না। সহজ জিনিসটাই তাদের বেশি পছন্দ। এই জটিল ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সহজ করার জন্য পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই। পেপারলেস ব্যাংকিং হলো ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং লেনদেন, যা ইলেকট্রনিক উপায়ে পরিচালিত। এটি কাগজের ব্যবহার কমাতে, প্রক্রিয়াগুলো সংক্ষিপ্ত করতে এবং গ্রাহকদের আরও সুবিধাজনক উপায়ে আর্থিক হিসাব পরিচালনা করার পন্থা জোগায়। মানুষ আজকাল খুব একটা ক্যাশ বহন করতে চায় না। এতে রয়েছে ঝুঁকি আর ঝামেলা। যেখানে একটি বারকোড স্ক্যান করলে সব পেমেন্ট করা যায়, সেখানে এত ঝামেলা না নেওয়াই স্বাভাবিক। তাই এখন ব্যাংকগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। ব্যাংকে গিয়ে চেক লেখা, কাউন্টারে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো বা নির্দিষ্ট লোকেশনে গিয়ে ব্যাংকের শাখায় টাকা জমা-উত্তোলন যেমন কষ্টের তেমন সময়ের অপচয়। তাই এখন ব্যাংকগুলো ব্যস্ত জায়গাগুলোতে সিআরএম বুথের ব্যবস্থা করেছে, যেখানে অল্প সময়ে টাকা জমা ও উত্তোলন করা যায় কোনো চেক লেখার ঝামেলা ছাড়াই। কোথাও ঘুরতে যাবেন, টিকিট বা হোটেল বুকিং দেওয়া প্রয়োজন। অনলাইনে টিকিট কেটে বা হোটেল বুকিংয়ে পেমেন্টে পাচ্ছেন আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট। কোনো একটি জিনিস পছন্দ হয়েছে; পর্যাপ্ত টাকা নেই। পকেটে থাকা ক্রেডিট কার্ড থাকলে হয়ে যাচ্ছে সমস্যার সমাধান। মানুষ আজকাল একের ভেতর সব চায়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আজ শুধু সঞ্চয়ের জন্য নয়; বেতন গ্রহণ, অর্থ প্রদান, ই-টিকিটিং সব কাজ করতে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টই যথেষ্ট। বলে রাখা দরকার, এই পেপারলেস ব্যাংকিং ব্যবস্থার নেপথ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগ, যার মধ্যে বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস ব্যবস্থা অন্যতম। তারও নেপথ্যে আছে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। মূলত ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের দেখানো এ স্বপ্ন যত বাস্তব রূপ নিয়েছে, ততই দেশের অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে ব্যাংক খাত দ্রুত পেপারলেস হওয়ার পথে এগিয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন তাদের সব প্রকল্পের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংক ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’কে সবচেয়ে সফল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ভবিষ্যতে পেপার মানির ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাবে। ফলে এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে নতুন প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে এবং সেবাকে সহজ ও সহজলভ্য করে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

বিষয়:

ধূমপান বা তামাক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

তামাক ব্যবহার বা ধূমপান অত্যান্ত ক্ষতিকারক, যা কার্যত মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত দেহের প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধূমপানে বিষপান, সবারই জানা। তবু বহু মানুষ ধূমপান করে। বাইরে থেকে দেখলে যদিও বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ধূমপানে নিঃশেষ হতে পারে প্রতিটি অঙ্গ। বিশ্বজুড়ে বহু মৃত্যু ও রোগের কারণ হলো তামাক, যা চাইলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এটি মানুষকে বয়সের আগেই মৃত্যুর দিকে টেনে নেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ৮৭ লাখ মানুষ সরাসরি তামাক সেবনে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য বিশেষ করে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, সাদা পাতায় আসক্ত এবং তামাকের কারণে বছরে প্রাণহানি ঘটে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের।

তামাকের ব্যবহার: তামাক অত্যন্ত নেশাদায়ক। দুইভাবে মানুষ তামাক ব্যবহার করে। যেমন-ধোঁয়াহীন তামাক যা জর্দা, গুল, সাদা পাতা, নাকে নস্যি ইত্যাদি। আরেকটি হচ্ছে ধোঁয়াযুক্ত তামাক যা সিগারেট, বিড়ি, চুরোট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ইদানিং আবার ই সিগারেট ব্যবহৃত হচ্ছে। সবই শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

ধূমপানের ক্ষতিকর কিছু দিক: তামাক সেবন কিংবা ধূমপান মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক অভ্যাস। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এ সম্পর্কে জানে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। ধূমপানের ফলে ধীরে ধীরে আয়ু কমতে থাকে।
ধূমপান ব্যবহার যে শুধু ধূমপায়ীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নয়, বরং পাশে থাকা অধূমপায়ীকেও সমানভাবে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে। ধূমপান বা তামাক ব্যবহারে যে ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হয় সেগুলো হলো-

(১) ক্যানসার: ধূমপানে হাজার হাজার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যার মধ্যে ৭০টি রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ক্যানসার সৃষ্টি করে। ধূমপানের কারণে ফুসফুস, মুখ, গলা, খাদ্যনালি, অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, যকৃত, বৃহদান্ত্র, মলাশয়, স্তন, মূত্রাশয়, কিডনি ও জরায়ুর ক্যানসার হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ফুসফুসে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা দশগুণ এবং মুখ, গলা, অন্ননালি, অগ্নাশয়, কিডনি, মূত্রথলি, জরায়ু মুখ ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কয়েকগুণ বেশি।
তামাকের ধোঁয়ায় থাকা কার্সিনোজেনিক পদার্থ মানবদেহের ডিএনএর ক্ষতি করে এবং ক্যানসার কোষের বিকাশ ঘটায়।

(২) শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা: ধূমপান সরাসরি ফুসফুসকে প্রভাবিত করে। এটি শ্বাসনালি ও ফুসফুসের অ্যালভিওলিকে ক্ষতি করে। ফুসফুসের বিভিন্ন ব্যাধি যেমন- দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা এবং সিওপিডির মতো শ্বাসযন্ত্রের জটিল সমস্যাগুলোর জন্য ধূমপানকে দায়ী করা হয়। যাদের হাঁপানি আছে তাদের জন্য ধূমপান অত্যধিক ক্ষতিকর। ধূমপায়ীদের যক্ষ্মা এবং ফুসফুসের ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

(৩) রক্তনালি ও হৃদরোগ: ধূমপানের কারণে রক্ত ও রক্তনালিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তামাকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর পদার্থ নিকোটিন, যা শরীরের রক্তনালিগুলোকে চিকন করে দেয় এবং রক্তনালির কোষগুলোকে নষ্ট করতে থাকে। রক্তনালিগুলোর মধ্যে প্লাটিলেট জমতে থাকে, ফলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে যারা ইতোমধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত তাদের ঝুঁকি আরও বেশি। ধূমপানে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ এবং উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ।

(৪) কোলস্টেরল: ধূমপানে রক্তে খারাপ কোলস্টেরল বা এলডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যায়, কমে যায় ভালো কোলস্টেরল এইচডিএলের মাত্রা। এতে রক্তনালিতে চর্বি জমে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, পায়ে পচনশীল রোগ বা বার্জারস ডিজিজ, গ্যাংগ্রিন।

(৫) পরিপাকতন্ত্রের ওপর প্রভাব: ধূমপায়ীদের দন্তক্ষয়, ক্ষুধামন্দা, হজমের সমস্যা, গ্যাস্ট্রাইটিস, গ্যাস্ট্রিক আলসার এবং বদহজমের সমস্যা হয়। সিগারেটের নিকোটিন মানুষের খাদ্যনালির স্ফিংটার বা দরজাকে অকার্যকর করে দেয়। ফলে অ্যাসিডিটি আরও বাড়ে এবং খাদ্যনালির প্রদাহ তৈরি করে।

(৬) গর্ভবতীর সমস্যা: ধূমপায়ী মহিলাদের মা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের জন্যও এটা বেশ ক্ষতিকর। গর্ভের সন্তানের ক্ষতি এবং অকাল গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ধূমপানের ফলে গর্ভবতী মায়ের অপরিপক্ব শিশু জন্মের ঝুঁকি বাড়ায় অধূমপায়ী নারীদের চেয়ে অন্তত তিনগুণ। অকালে শিশুর জন্ম হওয়া (প্রিম্যাচুর বার্থ), শিশুর কম ওজন হওয়া, জন্মের সময় নানাবিধ সমস্যাসহ শিশু মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

(৭) নিকোটিন আসক্তি বাড়ায়: তামাকের ধোঁয়ায়
নিকোটিন থাকে যা অত্যন্ত আসক্তিকারী একটি পদার্থ। ধূমপানের দশ সেকেন্ডের মধ্যে রক্তের মাধ্যমে নিকোটিন চলে যায় ব্রেইনে, যেটা ব্রেইন থেকে ডোপামিন এবং অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটারকে মুক্ত করতে সাহায্য করে, যেমন এনডরফিন। এগুলো মানুষের শরীরে ভালোলাগার প্রকাশ ঘটায় এবং নিয়মিত ব্যবহারে এক পর্যায়ে আসক্তি বা নেশায় পরিণত হয়। এই আসক্তির ফলে ধূমপান ত্যাগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

(৮) প্রজনন সমস্যা: ধূমপান নারী ও পুরুষ উভয়ের
প্রজননকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে। নারীদের ক্ষেত্রে প্রজনন সমস্যা, গর্ভাবস্থায় জটিলতা, অকাল জন্মের ঝুঁকি, কম ওজনের সন্তান জন্মদান ইত্যাদি। পুরুষদের যৌন ক্রিয়া-কলাপে অক্ষমতা বা ইরেকটাইল ডিসফাংশন এবং শুক্রাণুর গুণগত মান হ্রাস করে।

(৯) অন্যান্য জটিলতা: চোখে কম বয়সেই ছানি পড়তে পারে। ধূমপান হাড্ডিকে ভঙ্গুর করে তোলে এবং শ্রবণশক্তি কমে। ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমায়, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান ত্বকের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, ফলে অকালে বলিরেখা দেখা দেয় বা ত্বক বিবর্ণ হয়। ইমিউন সিস্টেম বা দেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় নিয়মিত ধূমপান, ব্যক্তির সংক্রমণ এবং অসুস্থতাকে দীর্ঘায়িত করে।

(১০) পরোক্ষ ধূমপায়ীদেরও ক্ষতি: বিড়ি-সিগারেট কেবল নিজে জ্বলে না, অন্যদেরও জ্বালায়। ধূমপান শুধু ধূমপায়ীর জন্যই বিপজ্জনক নয়, তার আশপাশে অধূমপায়ীদের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। যারা মনে করেন শুধু সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ধূমপানের ফলেই স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, তাদের ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। নিজে ধূমপান না করলেও এর প্রভাবে ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকা অন্য ব্যক্তিরা বা পরোক্ষ ধূমপায়ীরাও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পুড়ে যাওয়া তামাকের বিরক্তিকর ও বিশ্রি ধোঁয়া বায়ুদূষিত করে, পানি দূষিত করে এবং গোটা পরিবেশকেই দূষিত করে। ধূমপায়ীর ঘরে অধূমপায়ী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ থাকলে তারাও সমানভাবে নিশ্বাসের সঙ্গে এই বিষ গ্রহণ করে। বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের বেশি ক্ষতি হয়। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে দেহের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ক্যানসার প্রক্রিয়া গতিশীল হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি ধূমপানের মতোই পরোক্ষ ধূমপানের ফলে ক্ষতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে বাড়তে থাকে ফুসফুসের ক্যানসার আক্রান্তের ঝুঁকি। তাই এটিকে গুরুত্বসহকারে নেওয়া এবং সতর্কতা অবলম্বন অত্যাবশ্যক।

(১১) আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি: বিড়ি, সিগারেট কেনার খরচ এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্যসমস্যায় ব্যয়ের
কারণে ধূমপান ব্যক্তির ওপর উল্লেখযোগ্য আর্থিক প্রভাব ফেলে। ধূমপান সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কারণ পাবলিক স্পেসে ধূমপান নিষিদ্ধ।

ই-সিগারেট: এটি মূলত সিগারেটের বিকল্প। সিগারেটের মতো দেখতে না হলেও সিগারেটের বিকল্প হিসেবেই ই-সিগারেটের আবির্ভাব। ফ্যাশনেবল হওয়ায় ব্যাটারিচালিত এই যন্ত্রটিতে প্রায়ই টান দিতে দেখা যায় বর্তমান তরুণদের। অনেকে সিগারেট ছাড়ার জন্য ই-সিগারেট ব্যবহার করেন। এটিতে নিকোটিন, প্রপাইলিন গ্লাইকল অথবা ভেজিটেবল গ্লিসারিন এবং সুগন্ধি মিশ্রিত থাকে। এ ছাড়া ই-সিগারেটের প্রধান উপকরণ নিকোটিন থেকে দ্রুত আসক্তি তৈরি হয়। সিগারেট ছাড়ার বাসনায় যারা ই–সিগারেট ব্যবহার করেন, তাদের বরং উল্টো এর ওপর আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ই-সিগারেটে থাকা রাসায়নিক পদার্থ ফুসফুসের রোগ ও শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশন ঘটাতে পারে। ই-সিগারেটে যেভাবে রাসায়নিক নিকোটিন ব্যবহার করা হয়, এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে মৃত্যুও হতে পারে। তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। ই-সিগারেটে রয়েছে কার্সিনোজেনিক রাসায়নিক পদার্থ, যা থেকে ক্যানসার হওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাক নিয়ে তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ই-সিগারেটকে সুনিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

ইসলাম কী বলে?
তামাক একটি ক্ষতিকারক, অপবিত্র ও দুর্গন্ধময়
বস্তু ও খারাপ এটা সর্বজনস্বীকৃত। এ ব্যাপারে দুনিয়ার সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ একমত, কোনো স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীও দ্বিমত পোষণ করেননি। বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, হুক্কা, জর্দা, গুল ইত্যাদি
সেবনকারীর জন্য কোনো প্রকার পুষ্টির যোগান দেয়না, ক্ষুধাও নিবৃত্ত করে না। ইসলামে তামাকের মতো খাদ্যদ্রব্যকে বর্জনের কথা বলা হয়েছে। এটা খাবায়িসের অন্তর্ভুক্ত বলে তা খাওয়া বৈধ বা হালাল নয়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন: ‘তিনি তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন অপবিত্র বস্তুগুলোকে হারাম করিয়া দেন (সুরা আল-আরাফ: ১৫৭)। তামাক সেবনের মাধ্যমে জীবন জটিলতর হয়, দেহের ক্ষতি হয়, মানুষ তিলে তিলে নিজের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। অথচ এই ব্যাপারে সতর্ক করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআনে বলেন- তোমরা নিজদিগকে নিজেরা ধ্বংসের পথে নিক্ষেপ করোনা (সুরা আল-বাকারা: ১৯৫)। তিনি আরও বলেন: ‘তোমরা একে অন্যকে হত্যা করোনা’ (সুরা নিসা: ২৯)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ক্ষতি সাধন করোনা এবং
অপরের ক্ষতি সাধন করোনা (মুসনাদ আহমদ -সহীহ্ হাদিস)। হাদিসে আছে, নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো স্থান ইসলামে নেই (ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক, দারা কুতনি)। আর তামাক সেবন এমনই একটা বস্তু যা নিজের ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী লোকের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং ধন-সম্পদেরও অপচয় হয়। বিড়ি-সিগারেটের মধ্যে থাকা নিকোটিন ক্ষতিকর। এগুলো মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে। অথচ ইসলামে নেশাজাতীয় যেকোনো দ্রব্য গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আর যা নেশা উদ্রেক করে তাই নিষিদ্ধ’ (সহীহ্ মুসলিম :৫১১৪)।

ধূমপানের মাধ্যমে ঘটে অর্থের অপচয়। আর ইসলাম অপচয় ও অপব্যয়কে সমর্থন করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না’ ( সুরা আরাফ: ৩১)। সিগারেট আজকের দিনে কারও কাছে ফ্যাশন, কারও কাছে চরম বিরক্তিকর; তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে কিশোররাও সিগারেটের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সিগারেটের পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি থাকলেও সিগারেট যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এটা আজ সর্বজন স্বীকৃত। সুতরাং আসুন, ধূমপান তথা সব ধরনের তামাক সেবন বর্জন করি এবং সেটা আজ, এখন থেকেই। একটি কবিতার লাইন লিখে শেষ করছি:

‘জ্বলন্ত সিগারেটে জ্বলে এ জীবন,
বুঝতে পারেনা তবু প্রতারিত মন,
ধূমপানে পরিশেষে ঘনায় মরণ,
তবু কেন ধূমপান চলে আজীবন?’

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


রোহিঙ্গা সংকট ও বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

রোহিঙ্গা সংকট দুই প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ বাড়িয়েছে এবং এর ফলে আমরা মিয়ানমারের রাখাইন ও চীন রাজ্য, চলমান সংকট এবং দেশটি সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারছি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি চীন সমস্যা নিয়ে বেশ লেখালিখি হচ্ছে এবং সে জন্য ভারতের মিজোরাম সম্পর্কেও অনেক নতুন তথ্য আমাদের পাঠক জানতে পারছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও রাজ্যগুলো সম্পর্কে আমাদের পাঠকদের ধারণা আরও স্পষ্ট ও তথ্য সমৃদ্ধ হওয়ার অবকাশ আছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অশান্ত প্রতিবেশী সৃষ্ট সংকটের কারণে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। মিয়ানমার বাংলাদেশের মধ্যকার সীমান্তের নিরাপত্তা বর্তমানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে হুমকির মুখে রয়েছে ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যার বোঝা বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরে টেনে চলছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গোলাগুলির ঘটনায় বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো লাইনে মর্টার শেলের আঘাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের জনপদে গোলাগুলির কারেণে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় সেখানকার জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। সে সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা স্থলসীমান্ত ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, বাংলাদেশের আকাশসীমায় বিমানবাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং বাংলাদেশে গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকি তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। এ ধরনের আচরণ দ্রুত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের অন্তরায় এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে ও সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চারবার তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়। বাংলাদেশ সে সময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে সহিষ্ণু মনোভাব দেখিয়েছিল।

বর্তমানে এই ঘটনার আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে এ এ’র চলমান তুমুল যুদ্ধে একের পর এক মর্টার শেলের শব্দে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। সীমান্তের ওপারে সংঘর্ষের কারণে এপারের সেন্ট মার্টিনসহ টেকনাফের সীমান্ত এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছে। বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি ও মর্টার শেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দুজনের মৃত্যু ও নয়জন আহত হয়। এপ্রিল মাসে নাফ নদীতে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে দুই বাংলাদেশি জেলে আহত হয়, বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘাটে এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখানে অবস্থানরত মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজকে বাংলাদেশের পতাকা দেখিয়ে গুলি না করার সংকেত দেওয়ার পরেও তারা তা উপেক্ষা করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীর (বিজিপি) কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠায়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তার কারণে পরবর্তীতে প্রায় ৩০০ জেলে তাদের নৌকা নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যেতে পারেনি। এ ছাড়া বিজিপি সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফে ফেরার পথে একটি যাত্রীবাহী ট্রলার আটক করে প্রায় দুই ঘণ্টা তাদের আটকে রাখে। গুলিতে বাংলাদেশি জেলেদের আহত হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এসব ঘটনা প্রতিবেশী দেশের মধ্যেকার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নষ্ট করছে।

ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর এ এ’র সঙ্গে বিজিপির সংঘর্ষের তীব্রতায় বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মিয়ানমারের ৩৩০ জন বিজিপি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজে বিজিপি, সেনাবাহিনী ও শুল্ক কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিজিবির তত্ত্বাবধানে তাদের আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত বিজিপি সদস্যদের বিজিবির তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

এ এ’র সঙ্গে চলমান সংঘর্ষে মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ আরও ২৮৮ জন মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার দ্বিতীয় দফায় ২৩ এপ্রিল রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে বন্দর থেকে একটি নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠায়। ২৪ এপ্রিল জাহাজটি বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় এসে গভীর সাগরে অবস্থান নেয়। সেই জাহাজে ১৭৩ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয় যারা বিভিন্ন মেয়াদে মিয়ানমারের জেলে বন্দি ছিল। মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস দেশটির সরকারের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করে তাদের ফেরত পাঠায়। ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বিজিপি সদস্য, চারজন সেনা সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্যসহ মোট ২৮৮ জনকে বিজিপির কাছে হস্তান্তর করে ও তারা সেই জাহাজে মিয়ানমারে ফিরে যায়। বিজিবি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার বিজিপি, সেনা সদস্য ও অন্যদের মানবিক সহায়তা দিয়েছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি মেনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যা প্রশংসার দাবি রাখে।

রাখাইনে চলমান সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এ এ’র পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের থান্ডওয়ে টাউনশিপে এ এ এবং জান্তা বাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষের সময় কাছাকাছি থাকা জান্তা নৌবাহিনী ও এ এ’র অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সেনাবাহিনী এই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে থান্ডওয়ে টাউনের সব প্রবেশপথে আরও সামরিক চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে। সামরিক চেকপয়েন্টগুলো বাসিন্দাদের চাল ও জ্বালানি বহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ এ রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটওয়ে এবং চকপিউ টাউনশিপ ঘিরে রেখেছে, তারা অ্যান শহরে জান্তার ওয়েস্টার্ন কমান্ড এলাকার কাছেও আক্রমণ চালাচ্ছে। এর প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী স্কুল, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় স্থানসহ এ এ’র নিয়ন্ত্রণে থাকা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমাবর্ষণ করছে এবং পরিবহন, ইন্টারনেট এবং ফোন সংযোগ বন্ধ রেখেছে। ১১ মার্চ এ এ রাখাইনের দক্ষিণে রামরি শহর দখল করেছে। বর্তমানে সংঘর্ষ চলমান অঞ্চলের জনগণ খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক সুবিদার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ এ রাখাইন রাজ্যের রাজধানী দখলের জন্য অগ্রসর হচ্ছে এবং সংঘর্ষ বিস্তৃতি লাভ করায় বর্তমানে জান্তা রাখাইন জনগণকে ইয়াঙ্গুন ত্যাগ করতে বাধা দিচ্ছে। রাখাইন মিয়ানমারের দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাজ্য এবং এখানে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ না থাকায় প্রায় ৬০০০০ রাখাইনের অভিবাসী বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে কাজ করে। সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ জারির পরপরই, সরকার রাখাইন থেকে ইয়াঙ্গুনে আসা বিমান যাত্রীদের ওপরও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ এ এখন পর্যন্ত ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিসহ ১৮০টির বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে। তবে সমগ্র রাখাইনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, সেই সঙ্গে আরও অনেক রক্তক্ষয় হবে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও সশস্ত্র লড়াইয়ের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশকে সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে চাপ দিচ্ছে। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা ২০১৭ সালে জান্তাবাহিনীর নৃশংস দমনপীড়নের শিকার হয়ে রাখাইন থেকে পালিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা এবং আশ্রিত রোহিঙ্গারাও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশকে সব সময়ই মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

এ এ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর রাখাইনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মূলত এই এলাকা থেকেই এসেছে এবং প্রত্যাবাসন শুরু হলে তারা এখানেই ফিরে যাবে। ভবিষ্যতে যাই হউক না কেন এই এলাকা এ এ’র প্রভাব বলয়ে থাকবে। মিয়ানমারের সংকট ও সংঘাত প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ডের জন্যও বিপদের কারণ হচ্ছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘাত-সহিংসতা সীমান্তসংলগ্ন দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। রাখাইনে চীন, ভারত, জাপান ও অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে। তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় দেশগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। চীন জানুয়ারি মাসে এ এ ও সামরিক সরকারের মধ্যে সমঝোতার জন্য বৈঠক করেছে। ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় প্রতিনিধি এ এ’র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করছে। থাইল্যান্ডও সীমান্ত বাণিজ্য চলমান রাখতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ চলমান রোহিঙ্গা সংকট সত্ত্বেও মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এবং আন্তর্জাতিক আইন-কানুন মেনে সুআচরণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমারের চলমান সংকটের কারণে স্থানীয় জনগণ আতঙ্কে আছে এবং আমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের আচরণে আোদের জলসীমায় এখনো বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। মিয়ানমারের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার ও বিদ্রোহী উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। রাখাইন রাজ্যের স্থিতিশীলতা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আর্থিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা সমস্যা মোকাবিলায় এই সংকটের সমাধান জরুরি। চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুগ যুগ ধরে চলা রাখাইনে ও রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস তুলে ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি এনইউজি ও এ এ’র সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মতো বাংলাদেশকেও নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এমফিল (অব.) মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক


সবুজ কারখানায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন চ্যাম্পিয়ন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

দীর্ঘদিন থেকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে আলোচনা চলছে। শিল্পকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ, নেতিবাচক জলবায়ুর কারণে হুমকিতে গোট বিশ্ব। সংকট মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগও রয়েছে বিভিন্ন দেশের। তবে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। পোশাক উৎপাদনে পরিবেশসহায়ক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সবুজ কারখানা এখন বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। এই সবুজ কারখানা গড়ার দিক থেকে বাংলাদেশের কাছাকাছিও কোনো দেশ নেই। চীন বিশ্বের এক নম্বর পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ; কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারাও আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের দেশে এখন মোট পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ২১৫টি, যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই। এর মধ্যে প্লাটিনাম ৮১টি, গোল্ড ১২০টি, সিলভার ১০টি এবং সার্টিফায়েড চারটি।

সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুরের ফ্যাশন মেকারস যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) থেকে পরিবেশবান্ধব সনদ পেয়েছে। এই সনদ পাওয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ৯টি শর্ত পূরণ করতে হয়। মোট ১১০ নম্বরের মধ্যে কোনো কারখানা ৮০-এর বেশি পেলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ পেলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ নম্বর পেলে ‘লিড সিলভার’ এবং ৪০-৪৯ নম্বর পেলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ দেওয়া হয়। ফ্যাশন মেকারস লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে। তাদের অর্জিত নম্বর ৮৭। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে মর্যাদাশীল সনদটিই লাভ করেছে। বিশ্বের শীর্ষ ১০০ লিড গ্রিন কারখানার মধ্যে ৫৫টিই বাংলাদেশের। এর বাইরে পরিবেশবান্ধব কারখানা হওয়ার জন্য পাইপলাইনে আছে আরও প্রায় ৫০০টি। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে সবুজ কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ববাজারে ব্র্যান্ডিং হচ্ছে পোশাকশিল্পের।

প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পরিমাণের দিক থেকে পোশাক রপ্তানিতে প্রথমবারের মতো শীর্ষে বাংলাদেশ। গত কয়েক দশক এটি ছিল চীনের দখলে। এ কথা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারি যে বর্তমান সরকার বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পরিবেশবান্ধব সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশে লিড স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এই সংখ্যা দেশের টেকসই তৈরি পোশাকশিল্পের বিষয়ে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তার প্রমাণ। আমাদের সদস্যরা পরিবেশবান্ধব চর্চা, জ্বালানি সাশ্রয়ী পদক্ষেপ ও পানির ব্যবহার কমানোর মতো উদ্যোগ গ্রহণ করে যাচ্ছেন। এ কাজে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসছে এবং বিনিয়োগ করছে; যা খুবই ইতিবাচক।

দেশে নতুন বিনিয়োগের অনেক কারখানাই এখন সবুজ প্রযুক্তিতে নির্মাণ হচ্ছে। সবুজ কারখানায় রূপান্তরের চেষ্টা করছে পুরোনো বেশ কিছু কারখানাও। লিড সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হলে পোশাক খাতের এই সবুজ বিপ্লব বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে। এ ব্যবস্থাকে বলা যেতে পারে অর্থনীতিতে সবুজ ছোঁয়া। জানা যায়, লিড সনদের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষা এবং সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাশ্রয়ী উৎপাদন। এ ছাড়া সবুজ কারখানায় উৎপাদিত পোশাকের গায়ে একটি গ্রিন ট্যাগ থাকে। সচেতন ভোক্তাদের কাছে এর উচ্চ কদর রয়েছে।

সম্প্রতি জলবায়ু সম্মেলনে কয়েকটি ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বলেছে, যেসব কারখানা সবুজ প্রযুক্তিতে গড়ে ওঠেনি, ২০৩০ সালের পর সেসব কারখানা থেকে আর পোশাক নেবে না তারা। কাজ হারানোর এই ঝুঁকি নেই সবুজ কারখানায়। এদিকে ইউএসজিবিসির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সাধারণ একটি কারখানার তুলনায় লিড সনদ পাওয়া কারখানার জ্বালানি সাশ্রয় ২৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ। পানির ব্যবহার কম হয় ৪০ শতাংশ। বর্জ্য উৎপাদন কম হয় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কম হয় ১৩ শতাংশ। একটি রেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে কারখানার নকশা, নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর লিড সনদ দেওয়া হয়। ছোট বিষয়কেও গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন- শুধু কারখানার অবস্থান সূচকেই ২৬ রেটিং পয়েন্ট বিবেচনা করা হয়। স্থানীয়দের সহজ যাতায়াত, পরিবহন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও পয়েন্ট রয়েছে। এদিকে, পরিবেশ রক্ষায় সবুজ কারখানা নির্মাণে উৎসাহিত করছে সরকার। পোশাক খাতে করপোরেট কর সুবজ কারখানা হিসেবে সনদপ্রাপ্ত কারখানার জন্য কম করা হয়েছে। স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সবুজ প্রযুক্তি শিল্পকারখানায় অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তহবিল আছে, যেখান থেকে স্বল্পসুদে ঋণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।

গত ২৮ এপ্রিল ‘সুস্থ শ্রমিক, শোভন কর্মপরিবেশ, গড়ে তুলবে স্মার্ট বাংলাদেশ’- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে উদ্‌যাপিত হলো ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস’। এ উপলক্ষে ১২টি সেক্টরের ২৯টি কারখানা বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড-২০২৩’। কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটিসংক্রান্ত বিধিবিধান পালনকে সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের এমন উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এখন স্থায়িত্ব, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাস এবং দক্ষতার ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের বাজারের ভিত্তি শক্ত করছে।

বাংলাদেশ ২০১১ সাল থেকে পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক কারখানার সনদ পাওয়া শুরু করে; কিন্তু রানা প্লাজার ধসের পর থেকে কারখানার জন্য পরিবেশবান্ধব হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উদ্যোক্তারা কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করার তাগিদ দেন। আর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সফলতার জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাতে হয়। দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অবস্থাও টেকসই হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। এক সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছে অনেক। এখনো একটি মহল তৈরি পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করতে গভীর ষড়যন্ত্র আমরা লক্ষ্য করেছি। বেশ কয়েকমাস আগেও তৈরি পোশাকশিল্পে অস্থিরতা এবং নৈরাজ্যের পরিবেশ লক্ষ্য করেছি। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে কয়েক দফা তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতায় সম্মানজনক পরিবর্তন আনা হয়েছে। নানাভাবে পরিবেশ সৃষ্টি এবং উল্লেখযোগ্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের মুখে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প এখন রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

দেশের গার্মেন্ট খাতে সবুজ কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সুফল পাচ্ছি আমরা। আন্তর্জাতিক বাজারের ডোনারদের আগ্রহ বেড়েছে অনেকাংশে। আগের সব কালিমা নিশ্চিহ্ন করে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের একটি কদর তৈরি করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের এই সবুজ কারখানাগুলো বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ করছে। এর মাধ্যমে বিশ্বদরবারে আমাদের পোশাকশিল্পের সক্ষমতা তুলে ধরা যাচ্ছে। সবুজ গার্মেন্ট কারখানায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন চ্যাম্পিয়ন।

অনেকে মনে করে সবুজ কারখানা স্থাপনে অনেক জায়গার দরকার হয়, অনেক টাকা খরচ হয়। এ বিষয়ে আমি বলব- বিদেশি ক্রেতারা অনেক সচেতন। এখন হয়তো সবুজ কারখানার বিষয়ে ক্রেতারা খুব বেশি কথা বলছে না; কিন্তু আগামীতে তারা এ বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দেবে। এ ছাড়া অনেকে বলেন, সবুজ কারখানা করতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। এ বিষয়ে বলা যায়, এখন হয়তো টাকা খরচ হচ্ছে বেশি, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সবুজ কারখানায় আর বেশি ব্যয় হবে না অর্থ।

উন্নত দেশের তালিকায় নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও সবুজ কারখানা একটি অন্যতম ইন্ডিকেটর হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের মান উঁচু করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সরকারের তরফ থেকে মূলত চারটি ভিত্তি ঠিক করা হয়েছে- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ। এই চারটি মূল ভিত্তির প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। একটিকে বাদে আর তিনটি দিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। তারপরও বলা যায়, সবুজ কারখানার ভিত্তিতে সবুজ অর্থনীতি স্মার্ট বাংলাদেশকে গতি দিতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


উদার হও, উজাড় নয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খালেদা লিপি

আমরা এ রকম গল্প প্রায়ই শুনি যে, কোনো পরিবারের বড় ভাই বা বোন বাবার অক্ষমতায় বা অবর্তমানে পারিবারিক অসচ্ছলতায় নিজের কাঁধে পরিবারের সব দায়িত্ব তুলে নেন। নিজে পড়াশোনা না করে ছোট ভাইবোনদের পড়াশোনা করিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজের জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে দেয়। নিজেকে বঞ্চিত করে নিজ জীবনের সব চাওয়া থেকে। অতঃপর যখন ভাইবোনরা বড় হয়ে যায়, যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং যার যার মতো সংসার গড়ে তোলে তখন বড় ভাই বা বোনটি সবার দ্বারা লাঞ্ছিত হতে থাকে। এমন খুব কম উদাহরণ আছে যে, ওই ভাই বা বোনটি যথাযথ সম্মান, ভালোবাসা পায় তাদের আজীবন আত্মত্যাগের জন্য।

এখন প্রশ্ন হলো, যে ভাই বা বোনটি নিজের জীবনের সব কিছু আত্মত্যাগ করল তা কতটা যুক্তিযুক্ত? মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, সেহেতু সমাজ সভ্যতার প্রথম পরিচয়ের দিক হলো পরিবার। পরিবারে যারা যারা বাস করেন পরস্পরের প্রতি অবশ্যই দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকবেই। তবে কেউ কেউ আছেন, যারা নিজেকে উজাড় করে দিয়ে, পৃথিবীর সব ভুলে পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন খুশি মনে। আমি মনে করি, বড় হিসেবে সংসারের অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে, তবে তা কখনো নিজেকে ঠকিয়ে নয়।

সময়ের সঙ্গে প্রতিটি মানুষের মানসিক পরিবর্তন হতে থাকে। আজ যারা সংসারে দায়িত্বরত ভাই বা বোনটিকে বটবৃক্ষ ভাবছে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভুল শিক্ষার প্রভাবে প্রতিটি মানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তন স্বাভাবিক। দিন দিন ভাইয়ে-ভাইয়ে, বোনে-ভাইয়ে, এমনকি পরিবারের নতুন সদস্য যুক্ত হলে আত্মত্যাগ করা ভাই বা বোনটি তার প্রাপ্য সম্মান ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হন। কারণ নতুন সদস্যটি আত্মত্যাগ করা ভাই বা বোনটির গুরুত্ব বুঝতে পারে না বা বুঝেও নিজের বিবেকবোধহীনতায় সংসারে সমস্যা সৃষ্টি করে। সারাজীবন কষ্ট করার পরও সব আত্মত্যাগ এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তখন হাহাকার আর নিভৃত কান্না ছাড়া কিছুই করার থাকে না।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, সামান্য যা পরিমাণ পৈতৃক সম্পত্তি আছে তাই নিয়ে ভাই-বোন দ্বন্দ্বে জড়ায়। সারাজীবন যে বোনটি অন্যের সংসারে থেকেও তাদের জন্য ভেবেছে, তাদের আশ্রয়, প্রশ্রয় দিয়ে মানুষ করেছে তারাও সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করতে হবে বুঝতে পেলেই দূরত্ব বাড়ে মায়াময়, ভালোবাসাময় সম্পর্কগুলোতে। বাবা-মার বাড়িতে হাসি-আনন্দে বেড়ে ওঠা বোনটি বিয়ের পর বাবার বাড়িতে আর সেরকম মায়াময় জীবন পায় না। মা-বাবার কাছে, ভাইদের কাছে বোন আগের অধিকার যেন হারিয়ে ফেলে। আরও বেশি সমস্যা হয় যখন বোনরা বাবার সম্পত্তির ভাগ চায়। ভাইদের তখন আসল চেহেরা ফুটে উঠে এবং দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। ভাইয়েরা শুরু করে বোনকে বঞ্চিত করার নানা কৌশল। দুই বা ততোধিক ভাইয়ের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব এবং পরস্পরের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়।

এবার ফিরে যাই প্রথম প্রসঙ্গে, অতঃপর সব দায়-দায়িত্ব থেকে অবসর পাওয়ার পর সেই ভাই বা বোনটি যখন নিজের দিকে তাকায় তখন নিজেকে নিজে করুণা করারও সময় থাকে না। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত, সমাজ-সংসারের সব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের জীবনকেও প্রাধান্য দেওয়া। সময়কে গুরুত্ব দিয়ে নিজের প্রয়োজন, ইচ্ছাগুলোকে ডানা মেলতে দেওয়া। প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজেকে গড়ে তোলা, নিজের জীবনের প্রতি যত্নশীল হওয়া। এককথায় এভাবে বলা যায়, তা হলো উদার হও, তবে উজাড় হইয়ো না।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক


পরিবেশ সংরক্ষণে সেচ সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

ধান বাংলাদেশের একটি প্রধান ফসল। এ ফসলটি শুধু বাংলাদেশে নয়- এশিয়া তথা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অন্যতম একটি প্রধান ফসল। আমরা জানি, আমাদের বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত কৃষি ফসলের শতকরা আশিভাগেরও বেশি হলো ধান ফসল। তার মধ্যে অবার শতকরা ৬৭ শতাংশ হলো বোরো ধান। কাজেই তিন মৌসুমে ধান হওয়ার কারণে ধান ফসলটি সুষ্ঠুভাবে ফলানোর জন্য সেচ একটি অন্যতম অনুষঙ্গ।

পানি ছাড়া ধান আবাদ কল্পনাই করা যায় না। ধান আবাদে যেসব উপকরণ প্রয়োজন তার মধ্যে প্রধানতম হলো সেচ। আউশ, আমন ও বোরো- এ তিন মৌসুমের মধ্যে আমন এবং আউশ বৃষ্টিনির্ভর হলেও বোরোতে একেবারে প্রায় শতভাগই সেচনির্ভর। আর বৃষ্টির পানির প্রাকৃতিক বণ্টনটা এমন, দেখা গেছে একদিকে মৌসুমের শুরুতে পানির অভাবে ধান রোপণ করা যাচ্ছে না, অথচ ধান কাটার সময় আগাম বন্যা, পাহাড়ি ঢল কিংবা অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টিতে ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষক।

আশির দশক থেকে দেশে সেচ বিপ্লব ঘটতে থাকে। আর সেই সেচ বিপ্লবের কারণেই বোরো ধান এখন দেশের একটি প্রধান ফসল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বোরো ধান আবাদেই যেহেতু সবচেয়ে বেশি পানি সেচের প্রয়োজন হয়, সে জন্য এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখন বেশি নজর দেওয়া শুরু করেছেন। বোরো চাষের সময়টা মূলত শীতকালে এবং শুষ্ক মৌসুমে। সেটা ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত চলে। তখন বৃষ্টিপাত খুবই কম হয়। আবার পুরো মৌসুমে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। তা ছাড়া সে শুষ্ক সময়ে নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদি মুক্ত জলাশয়ও শুকিয়ে যায়। সে জন্য পুরো বোরো মৌসুমের সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত কাদা পদ্ধতিতে মাটির প্রকারভেদে পুরো বোরো মৌসুমে ১৫-৩০ বার পর্যন্ত সেচ প্রদান করতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), রুরাল ডেভেলপমেন্ট একাডেমি (আরডিএ) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণা ও ধারাবাহিক উন্নয়নের মাধ্যমে কীভাবে বোরো ধান আবাদে সেচের পানি সাশ্রয় করা যায়, বহুদিন থেকে সেই গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

সেসব গবেষণায় পাওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার লিটার সেচের পানির প্রয়োজন হয়। গত কিছুদিন আগে একাধিক সেমিনারে প্রদত্ত বক্তব্যের তথ্যানুযায়ী, এক কেজি ধান উৎপাদনের জন্য ভূ-গর্ভস্থ ৩২০০ লিটার সেচের পানির প্রয়োজন হওয়ার কথা জানা গেছে। সেসব প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ধান আবাদে ‘অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং (এডব্লিউডি)’ পদ্ধতিতেও সেচের পানি সাশ্রয়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে বেশকিছু দিন ধরে।

ধারাবাহিকভাবে ভেজানো এবং শুকানোর এ পদ্ধতির মাধ্যমে ধানের জমিতে তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর জন্য খুবই কম খরচে এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। এর জন্য প্রয়োজন হয় এক থেকে দেড় ফুট লম্বা প্লাস্টিক কিংবা স্টিলের এক টুকরা পাইপের। চারপাশে ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত সেই প্লাস্টিক কিংবা স্টিলের পাইপটি নির্ধারিত দূরত্বে পুরো জমিতে পুঁতে রাখতে হয়। জমির অতিরিক্ত পানি শুকিয়ে ফেলার সময় সেই পাইপের ভিতরে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, সেখানে পানি কতটুকু পরিমাণ আছে, কী নেই। তার ওপর ভিত্তি করেই সেই জমিতে সেচের সময় ও পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এতে অপ্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির পরিবহন বন্ধ করে সেচ নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।

অন্যভাবেও সেচের পানি হ্রাস করে লাভজনকভাবে বোরোধান আবাদ করার বিষয়ে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এ সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো হয়েছে। দেশবাসীর জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি সুখবর। প্রচলিত বোরো চাষ পদ্ধতিতে একটু পরিবর্তন এনে তা করা হচ্ছে। সেখানে প্রচলিত ধারার বীজতলা তৈরি ও সেখান থেকে ধানের চারা রোপণের পরিবর্তে অঙ্কুরিত ধানের বীজ প্রস্তুতকৃত অর্ধ-কর্দমাক্ত জমিতে সরাসরি রোপণ করে দেওয়া হয়। আর এ পদ্ধতিতে পুরো মৌসুমে ১৫-৩০ বারের পরিবর্তে মাত্র ৪-৮ বার সেচ দিলেই আরও বেশি ফলন পাওয়া যায়।

বাকৃবিতে কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান, বিভিন্ন সময়ে তার বেশকিছু গবেষণা সহযোগী এবং রিসার্চ ফেলোকে নিয়ে গঠিত গবেষক টিম দীর্ঘদিন গবেষণা শেষে একটি গণমুখী ফলাফল সুপারিশ করতে পেরেছেন। এ পদ্ধতিতে বোরো ধান আবাদের সুবিধাগুলো হলো- (১) প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ৫০-৬০ ভাগ পানি, ডিজেল ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। (২) ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোনো বীজতলা তৈরি করা ছাড়াই অঙ্কুরিত ধানের চারা সরাসরি অর্ধ-কর্দমাক্ত জমিতে লাগিয়ে দিতে হয়।

বীজতলার অন্তর্বর্তীকালীন সময়টা না লাগার কারণে ধানের জীবনকাল কমপক্ষে ১৫ দিন কমে আসে। (৩) রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ইত্যাদি অঞ্চলে এ পদ্ধতির ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। (৪) ব্রি-ধান ২৮ এবং ব্রি-ধান ৫৮ জাতগুলো ময়মনসিংহসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে আবাদের জন্য এ গবেষণা চালানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। (৫) উত্তরাঞ্চল বিশেষত রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিজমির উপরিভাগ সর্বত্র সমানভাবে সমতল না হওয়ার কারণে সেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া খুবই অসুবিধাজনক। তা ছাড়া উত্তরাঞ্চলের যেসব স্থানে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে সেসব অঞ্চলের জন্য এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর।

(৬) এ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে আগাছা দমন একটি বড় সমস্যা ছিল; কিন্তু বর্তমানে অনেকাংশেই তা কাটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। (৭) আমরা জানি, সবুজ বনানী থেকেও প্রতিনিয়ত পরিবেশ ধ্বংসকারী মিথেনসহ অন্য গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়ে থাকে অনবরত। সেখানে ধানগাছও এর বাইরে নয়। যত বেশিদিন তা মাঠে থাকবে ততদিনই এসব গ্যাস নিঃসরণ করবে। সে জন্য সময় কম এবং পানির পরিমাণ কম লাগার কারণে ধান গাছ থেকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্রিন হাউস গ্যাস কম নিঃসৃত হয়। (৮) অন্যদিকে বোরো আবাদে যেহেতু প্রায় শতভাগ সেচের পানির জন্যই ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়।

সে জন্য পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে ভূ-গর্ভস্থ পানির এ ক্রমাগত উত্তোলন পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে প্রতিভাত। (৯) ফেব্রুয়ারিতে বপন করতে হয় বিধায় বোরো ধান লাগানোর আগে আমন ধান কাটার পর সরিষা, আলু ও অন্যান্য রবি ফসল এর ফাঁকে উৎপাদন করে নেওয়া সম্ভব। এতে বর্তমানে ফসলক্রমের সঙ্গে আরেকটি ফসল যুক্ত হয়ে ফসলের নিবিড়তা বাড়ে। (১০) এভাবে সেচ সহজলভ্য হবে এবং সেচের জন্য বাড়তি খরচ বেঁচে যাবে। ফলে উৎপাদন খরচ কমে গিয়ে কৃষক লাভবান হবে। কাজেই এসব পদ্ধতি সারা দেশে কার্যকরভাবে সম্প্রসারণ করতে পারলে কৃষি ও কৃষক তো উপকৃত হবেই, সেই সঙ্গে বাঁচবে পরিবেশও।

জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি উল্লেখ করার মতো বিষয়। আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি তার কুফল হিসেবে পরিগণিত। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কৃষির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদান অনস্বীকার্য। আর সেই অবদান সৃষ্টির অংশ হিসেবে বোরো আবাদের এ পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি খুবই কার্যকরভাবে অনুসরণ করতে হবে। বোরোর মতো একটি প্রধান ধান ফসলে এগুলো করতে পারলেই একদিকে যেমন কৃষি লাভজনক হবে অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত হতে মুক্তি পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


শ্রমজীবী মানুষ, মূল্যস্ফীতি ও জীবন-জীবিকা প্রসঙ্গ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মিহির কুমার রায়

মহান মে মাস। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতির মাস। শ্রমিকদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতি বছর ১ মে সারা বিশ্বে দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করা হয়। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য-‘শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ।’

মহান মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব শ্রমজীবী মানুষকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প ও শ্রমবান্ধব বর্তমান সরকার শ্রমিকের সার্বিক কল্যাণসাধন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নত কর্মপরিবেশ, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের পেশাগত নিরাপত্তা, সুস্থতাসহ সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রম আইন যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। আমরা রপ্তানিমুখী গার্মেন্টশিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করেছি এবং সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি। সব সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে।

১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওই সময়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি অজ্ঞাতনামা কেউ বোমা নিক্ষেপ করলে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায়। এতে ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হন। ওই দিন তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিশ্বে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ শিকাগোর হে মার্কেটে দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়। তবে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় আরও পরে। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালে আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর ১৮৯৪ সালে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এই ধারাবাহিকতায় ১০০ বছর পর ১৯০৪ সালে আর্মস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ওই প্রস্তাবে বিশ্বজুড়ে সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার’ সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে সারা বিশ্বে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

শ্রমিক মজুরি, মূল্যস্ফীতির হার ও জীবনের গল্প:

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত মার্চে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। আগের বছরের একই মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল আরও বেশি, ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর ১২ মাস ধরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়েনি শ্রমজীবীদের মজুরি। বিষয়টি বিবিএসের তথ্যেও উঠে এসেছে। গত মার্চে সাধারণ মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে মূল্যস্ফীতির তুলনায় তা কম ছিল ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায়ই সার্বিক মূল্যস্ফীতিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের শ্রমজীবীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্য গ্রহণ এবং চাহিদা ছেঁটে জীবনযাপনের ব্যয় সংকুলান করছেন। জীবিকা নির্বাহ কঠিন হওয়ায় অনেকে আবার শহর ছাড়ারও চিন্তা করছেন। তাদেরই একজন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ইউনুস আলী। আগে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে অন্যের কৃষিজমিতে কাজ করতেন। সেই আয় দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হওয়ায় পাড়ি জমান ঢাকায়। কারওয়ান বাজারে এখন কুলির কাজ করছেন। থাকেন একটি মেসে। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে নিজের খাবার খরচ ও মেস ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে তেমন টাকা পাঠাতে পারছেন না বলে জানান। তাই আবার গ্রামে পরিবারের কাছেই ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন ইউসুফ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকৃত আয় না বাড়ায় শ্রমিকদের ভোগ কমছে। দীর্ঘমেয়াদে জীবনযাত্রার মান কমে গিয়ে তারা চরম দারিদ্র্যসীমায় নেমে যেতে পারেন। আর ভোগ কমলে বিনিয়োগও কমবে। ফলে কমে আসতে পারে প্রবৃদ্ধিও। টিকতে না পেরে ২০২৩ সালে প্রতি হাজারে প্রায় ১৪ জন শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান। পাঁচ বছর আগে এ হার ছিল একজনেরও কম। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ১৩ দশমিক ৮ জন। আগের বছর এ হার ছিল ১০ দশমিক ৯ জন। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৫ দশমিক ৯ জন শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি দেন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৪ জনে। ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছেন একজনেরও কম বা দশমিক ৭ জন। অর্থাৎ আগের চেয়ে বেশি মানুষ এখন শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন।

তীব্র তাপপ্রবাহের প্রভাব জীবনমানে:

চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঠিকমতো বাইরে কাজ করতে পারছেন না শ্রমিকরা। এতে তাদের আয় কমে গেছে। সংসার চালাতে অনেককে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। বরগুনা থেকে ঢাকায় এসেছেন নজরুল ইসলাম। জীবিকা নির্বাহ করছেন রিকশা চালিয়ে। এফডিসি মোড়ে তার সঙ্গে কথা হলে জানান, রোদের প্রখরতায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। কিছু সময় পরপর পানি বা শরবত পান করতে হচ্ছে, তাতে বাড়তি ব্যয়ও গুনতে হচ্ছে। অথচ সে অনুযায়ী আয় নেই তার। নিম্ন আয়ের মানুষকে মজুরির একটি বড় অংশই ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতেই। অথচ মূল্যস্ফীতির তুলনায় তাদের আয় বৃদ্ধির হার সেভাবে বাড়েনি। আর খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রংপুর থেকে ঢাকায় এসে রিকশাভ্যান চালান আলম মিয়া। তিনি জানান, আগে গাড়ির জমা হিসেবে দিনপ্রতি মালিককে দিতে হতো ১৫০ টাকা করে। এখন সেটি বাড়িয়ে দিতে হয় ২০০ টাকা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাম বেড়ে গেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে কম মজুরি বাড়ছে শিল্প খাতের শ্রমিকদের। গত মার্চে এ খাতের মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ মজুরির তুলনায় তাদের মজুরি বৃদ্ধির হার আরও কম। যদিও কৃষি ও সেবা খাতের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ শতাংশের বেশি। দেশে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির আগেও মূল্যস্ফীতির তুলনায় শ্রমিকের মজুরি হার ছিল বেশি। পণ্যের দামের চেয়ে মজুরি বেশি পাওয়ায় শ্রমিকের প্রকৃত আয় বা ক্রয়ক্ষমতাও বেশি ছিল তখন; কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত টানা ২৬ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে শ্রমের মূল্য কম, যা দারিদ্র্যসীমার হারকে উসকে দিচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বক্তব্য, ‘প্রকৃত আয় না বাড়ায় শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বাড়ছে না। ফলে তাদের জীবনমান কমছে। দীর্ঘমেয়াদে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। আর ভোগ কমায় বিনিয়োগ কম হবে। এতে প্রবৃদ্ধিও কমে আসবে। এটার প্রভাব থাকবে খানা ও জাতীয়পর্যায়েও। সামাজিক অসন্তোষ ও বিচ্ছিন্নতাবোধও বাড়তে পারে এ কারণে।’ বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের কম। অর্থাৎ এসব এলাকায় মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেশি। সিলেটে মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ৫৩ আর বরিশালে ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। দেশের ৬৩ খাতের তথ্য সংগ্রহ করে মজুরি বৃদ্ধির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিএস। এর মধ্যে ১৭টি খাত কৃষিসংক্রান্ত, শিল্পসংশ্লিষ্ট ৬৩টি ও সেবাসংক্রান্ত খাত রয়েছে ১৬টি।

মূল্যস্ফীতি বাড়লে দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, যারা দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি ছিল চলমান পরিস্থিতির কারণে তারা সীমার নিচে নেমে যাবে। আর এটা চলতে থাকলে চরম দারিদ্র্য ও বৈষম্যও বেড়ে যাবে।’ বিবিএস মূলত ১২টি খাতের সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করে। মূল্যস্ফীতির খাতভিত্তিক তথ্যমতে, খাদ্যের পাশাপাশি বাসা ভাড়া, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির বিল বাবদ ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে। মার্চে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বাড়ির আসবাব খাতে এ হার ছিল ১৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। বিনোদন খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৭ শতাংশের বেশি।

এ ব্যাপারে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন ‘মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে সেভাবে মজুরি বাড়েনি। তার বড় কারণ শ্রমিকের চাহিদা না বাড়া। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলার সংকটসহ আমদানি নিয়ন্ত্রণের প্রভাবে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। ফলে শ্রমের চাহিদাও কম। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলে এবং অর্থনীতি চাঙ্গা হলে শ্রমিকের মজুরি আবার বেড়ে যাবে। এটা সাময়িক সমস্যা, দুই-তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে তার বক্তব্য হলো- উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ভালোভাবে নজর দিতে হবে। সরকার অবশ্য সামাজিক সুরক্ষা জোরদারে চেষ্টা করছে। আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ও সেবার পরিধি বাড়বে বলে আশা করছি আমরা। টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। সরকার এ বিষয়ে সজাক রয়েছে।

কৃষি শ্রমিক ও মে দিবস:

কৃষিতে শ্রম দিয়ে যারা জীবিকা অর্জন করে তাদের কৃষি শ্রমিক বলা হয়। নানা কারণে কৃষিতে শ্রমশক্তি ক্রমহ্রাসমান। ২০০০ সালে দেশের মোট শ্রমশক্তির মধ্যে ৬০ শতাংশ ছিল কৃষি শ্রমিক। সেটি কমে বর্তমানে ৩৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ২০ শতাংশে ঠেকতে পারে। মূলত কৃষি শ্রম খাতে অবহেলার কারণে দেশে কৃষি শ্রমিকের হার দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রণোদনা, কৃষি ঋণ, বিনামূল্যে এবং ভর্তুকি মূল্যে উচ্চফলনশীল বীজ সরবরাহ, সারসহ কৃষি উপকরণে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান ইত্যাদির প্রচলন থাকলেও কৃষক যখন মাঠে কাজ করবেন তখন তার স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা তথা মানসিক প্রশান্তির জন্য কোনো অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। প্রখর রোধে তারা কাজ করলেও বিশ্রাম নেওয়ার কোনো জায়গা নেই। কৃষককে মাঠে-ঘাটের নোংরা কাদামাটির ওপর বসেই খাবার খেতে হয়। কাছাকাছি কোনো নিরাপদ পানির উৎস না থাকায় অনিরাপদ পানি খেতে হয়।

প্রতি বছর মে দিবস এলেই শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে নানা রকম সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। সংবাদপত্রে বের করা হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচার করা হয় আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ও টক শো। মে দিবস আসে আবার চলেও যায়। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকশ্রেণি তথা কৃষিশ্রমিকদের কথা থাকে উপেক্ষিত। অথচ কৃষিভিত্তিক আমাদের এ দেশ বাংলাদেশ। মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ ভাগ এখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত; কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির সর্বাধিক এ খাতটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা দেখা যায় না। উপরন্তু কৃষিশ্রমিকদের নেই কোনো সংগঠন, সমিতি বা কারখানার শ্রমিকদের মতো ট্রেড ইউনিয়ন। আর তাই তাদের মৌলিক মানবিক ও সামাজিক অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং নানা সমস্যা থেকে যায় অতল অন্ধকারে।

কৃষিশ্রমিকদের অর্ধেকই হলো আবার নারী কৃষিশ্রমিক। যেখানে কৃষিশ্রমিকদের শ্রমিকশ্রেণির অংশই মনে করা হয় না সেখানে নারী কৃষিশ্রমিক যারা ফসল রোপণ-বপন, পরিচর্যা এবং ফসল সংগ্রহোত্তর কার্যক্রমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত তাদের অবস্থান কোথায় তা সহজেই বোধগম্য। বিগত জাতীয় কৃষি শুমারিগুলোর রিপোর্টে দেখা যায়, দেশে কৃষি খামারের সংখ্যা ও আয়তন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বেড়েছে ভূমিহীন ও বর্গাচাষির সংখ্যা। গ্রামে বর্গাচাষির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কৃষি খামারের আয়তন কমে যাওয়ায় কৃষি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু নয়। দ্রুত নগরায়ণ ও গ্রামে ভূমিহীনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শহরেও ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। উচ্চমূল্যের কৃষি উপকরণ, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগী ও মহাজনের দৌরাত্ম্য, কৃষিতে জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাব, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকরা খাপ খাওয়াতে না পারা প্রভৃতি কারণে স্বাধীনতা-উত্তর ক্রমান্বয প্রান্তিক কৃষকরা ভূমিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। বর্তমানে এদের অবস্থা হয় বর্গাচাষি বা কৃষি দিনমজুর কিংবা নগরশ্রমিক। খুলনা বিভাগে জমিতে লবণাক্ততা ও রাজশাহী বিভাগে খরা এবং পানি স্বল্পতার কারণে অনেক জমি কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ফলে বেকার হয়ে পড়ছে কৃষিশ্রমিক। এ ছাড়া দেশে কৃষিশ্রমিকদের সারা বছর নিরবচ্ছিন্ন কাজ থাকে না। তাই তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এ জন্য আমরা লক্ষ্য করি ধান কাটার মৌসুমে পর্যাপ্ত কৃষিশ্রমিক পাওয়া যায় না।

উপসংহার:

সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে সজাগ রয়েছে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণে শ্রমিকদের সঙ্গে করে দেশকে গড়বে । মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। দেশে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অন্য পেশাজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়লেও অনেকেই পিছিয়ে রয়েছেন। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতন অনিয়মিত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। জয় হোক মেহনতি মানুষের।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হীরেন পণ্ডিত

অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের ইচ্ছামতো চলাই স্বাধীনতা, হার্বার্ট স্পেন্সার তাই বলেছেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি তথ্যভিত্তিক সংবাদও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কার্যক্রম নিয়ে যেকোনো সমালোচনা যে কেউ করতে পারে। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে যখন ধারাবাহিক মিথ্যাচার করা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে। সেসব সংবাদ নিয়েও জনগণের মনে নানা প্রশ্ন থাকতে পারে।

১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে অথবা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথগ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় এই দিবসে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ ও মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আইন কমিশন ও বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহ্যগতভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করতেই ভূমিকা পালন করে থাকে।

এটি অনস্বীকার্য যে বাক্-স্বাধীনতা অধিকারের রক্ষাকবচ অবশ্যই যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষেই নাগরিক ও সাংবাদিকরা ভোগ করে থাকেন। কেউ সেই বিধি-নিষেধ না মানলে তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। গণমাধ্যমের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রেস কাউন্সিলকে অধিকতর শক্তিশালী করা হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, সার্বিকভাবে গত এক যুগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সুবিশাল কর্মযজ্ঞে দেশে গণমাধ্যমের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

পিআইডির তথ্য থেকে জানা যায়, গণমাধ্যমের উন্নয়নে এ সময়ে নতুন দুই হাজারের বেশি পত্রিকা নিবন্ধিত হয়েছে; বেসরকারি খাতে নতুন ৪৪টি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদনসহ ২৮টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিওকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ও ষান্মাসিক মিলিয়ে মোট পত্রিকার সংখ্যা দুই হাজার ৮৫৫। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্র নিয়ে সরকারি চারটি ও অনুমোদনপ্রাপ্ত ৪৪টি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন। পিআইডির প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানানো হয়েছে, ‘দেশের উন্নয়নকে টেকসই, গতিশীল ও অংশগ্রহণমূলক করতে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কোনো বিকল্প নেই।

বর্তমান সরকারের এই অন্যতম মূলমন্ত্র বাস্তবায়নে কাজ করছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করার দৃঢ় প্রত্যয় সেই কাজেরই অংশ।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছে নেই। তবে যারা সরকারের উন্নয়নের অপপ্রচার করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি বলেন, ‘রামপাল নিয়ে অনেক মিথ্যাচার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মিথ্যা হচ্ছে, ভারত নিয়ে মিথ্যাচার। রিপোর্টিংয়ের সততা থাকতে হবে। যেকোনো ধরনের সমালোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই, তবে মিথ্যাচারকে নয়।’

ইউনেস্কো, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ও আর্টিকেল ১৯ আয়োজিত ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৪’ উপলক্ষে ‘বর্তমান বৈশ্বিক পরিবেশগত সংকটের প্রেক্ষাপটে মুক্ত গণমাধ্যম এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নামে যখন এর অপব্যবহার হয়, তখন এটার পরিণাম হয় খুবই ভয়াবহ, এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। গত ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের প্রসার ও এর স্বাধীনতার জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে। আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আমরা স্বাগত জানাই, যারা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে চায়। আমরা শুধু উন্নয়নই করতে চাই না, আমরা টেকসই উন্নয়ন করতে চাই, যেটা আমাদের পরিবেশকে সুরক্ষা দেবে।’

বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। ক্রমবর্ধমান ভূমি দস্যুতা, উন্নয়নের নামে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা, নগরায়ণের নামে জবর দখল এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। পরিবেশের ওপর এমন আগ্রাসনে ক্ষমতাসীনদের একাংশ লাভবান হচ্ছে বিধায় এ দের সুরক্ষা দিচ্ছে তারা। এসব নিয়ে যারা কাজ করবে গণমাধ্যমসহ সুশীল সমাজ, সেই পরিবেশ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। আইনের মধ্যেও দুর্বলতা রয়েছে। যাদের আইন প্রয়োগ করার কথা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা, তাদেরও যোগসাজশ রয়েছে বলে টিআইবি উল্লেখ করে।

সাংবাদিকতা সারা বিশ্বেই চ্যালেঞ্জের মুখে। পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতা একটু বেশি চ্যালেঞ্জিং। বালুমহাল, পাহাড় কেটে লেক তৈরি, এসবের পেছনে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা জড়িত। তাদের বাধার মুখে পড়তে হয়। টিভি সাংবাদিকদের দেখার কেউ নেই। ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকরা কোনো একটা কাজ করতে গেলে, বিপদে পড়লে কেউ পাশে থাকে না।

তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘দেশের গণমাধ্যম শুধু মুক্ত নয়, উন্মুক্ত। তবে যারা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করছে, তাদেরকে সরকার নজরদারিতে আনতে চায়।’ তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছে সরকারের নেই। তবে যারা দেশের উন্নয়নের অপপ্রচার করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সরকার কমিটেড। গণমাধ্যম শুধু মুক্ত নয়, উন্মুক্ত। বরং সরকারকেই অনেক সাংবাদিক নিবন্ধনহীন অনলাইন বন্ধ করার কথা বলেন। গণমাধ্যম কর্মীদের তালিকা করতে বলে, কে কোথায় কাজ করে। আমরা কিন্তু সেটা করছি না। আমরা চাই একটা নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সবাই আসুক। সুস্থ ধারার সাংবাদিকতায় কোনো বাধা নেই।

তবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যবহার করে যাতে আইনের অপব্যবহার না হয়, সে ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সঠিক তথ্য-উপাত্তের বিপরীতে ডকুমেন্টস থাকে, তার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ নেই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে কোনো নিজস্ব পারপাস সার্ভ করা নয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নামে যখন এর অপব্যবহার হয়, তখন এর পরিণাম হয় খুবই ভয়াবহ। এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। গত ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের প্রসার ও এর স্বাধীনতার জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকার অঙ্গিকারবদ্ধ। আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। পরিবেশকে সুরক্ষিত করতে চাই।

রামপাল ও আদানি গ্রুপ নিয়ে দিনের পর দিন মিথ্যাচার হয়েছে। এটা যে ক্ষতিকর সেটা সত্যি নয়। আমরা আমাদের স্বার্থে এনটিএমসিকে বাংলাদেশে এনেছি। তাদের ৭০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প করার অভিজ্ঞতা আছে। আমরা এক্সিম ব্যাংকের বিনিয়োগ এনেছি। আমরা চেয়েছি পার্টনারশিপের মাধ্যমে বিদ্যুতের উন্নয়ন। পুরোটাই বাংলাদেশের স্বার্থ। ওখানে ৫০-৫০ পার্টনারশিপ, লাভ যা হবে তাও ভাগ হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের গার্মেন্টন্স ও পাহাড়ি এলাকা নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হয়। এটা সত্যি। সরকার সব সময় সমালোচনাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু যখন সিস্টেমেটিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়, আমরা সেটার বিরুদ্ধে। পরিবেশ বিপর্যয় কিংবা দুর্নীতি নিয়ে যেকোনো প্রতিবেদনকে স্বাগত জানাই। আমি এখনো বলে যাচ্ছি, এই ধরনের সাংবাদিকতা রক্ষায় সঙ্গে আছি।’

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সুচকে পিছিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৩ সালের মে মাসে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে ভুল তথ্য আছে এবং সেখানে বাস্তবতার প্রতিফলন ছিল না। ওয়েবসাইটে ভুল, অর্ধসত্য ও অপর্যাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৬৩তম দেখানো হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা চিঠি লিখেছি, তারা ভুল তথ্য ডিলিট করেছে। কিন্তু র‌্যাংকিং ঠিক করা হয়নি।

সংবাদ প্রকাশের জেরে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা, মামলা বা হয়রানির ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় অনেক সময় শুধু সংবাদ সংগ্রহ বা সংবাদের জন্য সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন এর সংখ্যা খুব বেশি নয় তবে তথ্য বা সংবাদ প্রচারের চেয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতার সংখ্যা অনেক বেশি। পাশাপাশি সাংবাদিকদের তথ্য পাওয়ার সুযোগও দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে এই অভিযোগও ঠিক নয় সরকারের সব তথ্য এখন ওয়েবসাইটে দেওয়া অছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশ আটকাতে এবং তথ্য সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চলছে নানা তৎপরতা এই অভিযোগ সঠিক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে অলিখিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, তবে এটাও সত্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সংবেদনশীল জায়গা। ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনে স্পষ্ট বলা আছে কোন তথ্য দেওয়া যাবে কোনটা যাবে না।

তথ্য প্রদানের জন্য সব সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একজন তথ্যপ্রদানকারী কর্মকর্তা রয়েছে। যে কারণে তথ্য অধিকার আইন করে অনেক বেশি লাভ হয়েছে। তথ্য পাওয়া নাগরিক অধিকার। জনগণের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি আছে। এটি নিশ্চিতে সাংবাদিক প্রবেশে কোথাও নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে সংবেদনশীল অফিস ও তথ্যগুলো সবাইকে সেদিক থেকেই ভাবতে হবে।

সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর এমনকি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানেও পেশাগত কাজে প্রবেশ করতে কোনো বাধা নেই। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাংবাদিকদের প্রবেশ একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কেউ যখন তথ্য চাইবেন, তা পাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তথ্য পাওয়া নাগরিক অধিকার। জনগণের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি আছে, সেভাবেই সবাইকে কাজ করতে হবে।

নানা সীমাবদ্ধতার পরও এগোচ্ছে, মুক্ত গণমাধ্যমও এগোচ্ছে, এগোবে। আরও এগোতে হবে। গণমাধ্যমকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সোপান হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। তবে গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। গণমাধ্যম মানুষের জন্য তথ্যের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করে। তবে অনেক সময় গণমাধ্যমকেও পক্ষপাতিত্ব করতে দেখা যায়। নানা মতাদর্শের ভিন্ন আঙ্গিকের সংবাদ জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা হয়। এর মাধ্যমে গণমাধ্যম অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে।

ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনসাধারণ সরাসরি মত প্রকাশ করতে পারছেন। এখন আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধু সংবাদপত্রের ওপরই নির্ভর করে না। এতে যুক্ত হয়েছে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ও ব্লগ। তবে এসব মাধ্যমের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষায় অনেক সময় ভুল সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা হয়, এর ফলে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়। মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রভাবও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

গণমাধ্যমের কাজ হলো এই জনগণের বার্তা নিরপেক্ষ ও নির্ভুলভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরা। একটি দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে কি নেই এবং নাগরিকের চিন্তার স্বাধীনতা আছে কি নেই, তা দিয়ে সহজেই গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি পরিমাপ করা সম্ভব। গণমাধ্যমের সমন্বয়হীনতা রোধ করা জরুরি। দেশ, জাতি, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের বিষয়টি বরাবরই সমুন্নত ইন্টারনেটের কল্যাণে মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইন সংবাদমাধ্যমসহ ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বড় ধরনের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিপ্লব ঘটিয়েছে বলা যায়।

সব সময় দেশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সুশাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশের অদম্য যাত্রা অব্যাহত রাখবে মিডিয়া।

লেখক: হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট

বিষয়:

banner close